খবরইন্ডিয়াঅনলাইনঃ
স্মৃতি বিতরণ
বাবা!
এই শব্দটিতে এখন আর সেই ভাবে কাউকে ডাকা হয় না। মাঝেমধ্যে ছেলেকে বাবাই ডাকি। মনে পড়ে বাবার সামনে একদিন ছেলেকে বাবা ডাকায় বাবা খুব শিশুসুলভ অভিমান নিয়ে বলেছিলেন,- কিরে আমি থাকতে তুই তোর ছেলেকে বাবা ডাকছিস!
তখন বাবা আমার বাসায় এলে খুব সাবধানে থাকতাম।ছেলেকে সত্যি সত্যি বাবার সামনে আর বাবা ডাকতাম না।
কাকডাকা ভোর।অবশ্য সে তল্লাটে তখন কাক ছিলো না। অনেক জানা না জানা পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ছিলো।বাবা মায়ের পাশের রুমে আমি আর আমারই বয়সী কর্মসহযোগী খায়রুনসহ থাকতাম।সেই ভোর বেলায় আমার পাঁচ বছরের বোনKaniz Fatema (সুমি) ও তিন বছরের বোনAfruza Begum (সুইটি)কে ডেকে তুলে বাবা প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন। ঘুমঘুম চোখে মুখ ধুয়ে,একই রকম কাপড়ের ড্রেসে তিন বোনকে খালি পায়ে হাঁটতে বের করতেন তিনি। সুরকীর পথ।কিছুটা এ পথে যেতে হতো।পায়ে খুব ব্যথা হতো।
সমনেই ঢাকা- ময়মনসিংহ রোড।এখন যেমন খুব গাড়ি চলে তখন এতো গাড়ি ছিলো না।সেসব ১৯৮০/১৯৮১ সালের কথা।
M.j. Kabir Tipu( টিপু) তখন কুমিল্লাতে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলে পড়ে।হোস্টেলে থাকে।ছোটভাই Hasan Mahmud(টিটু) তখনও পৃথিবীর আলো দেখে নি।
সেই সব ভোরে,বাবার দুই হাত ধরা ছোট দুই বোন।আমি পেছনে।কিছু দূর হাঁটার পর বাবা অফিসঘরের সামনের ঘাসের মাঠে ওদের ছেড়ে দিতেন।বলতেন,-সকালে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
ওই সময় বাবার মুড থাকতো অন্যরকম ভালো।ঘাসের ডগায় লেগে থাকা শিশিরে পা ভিজে যেতো।সূর্য উঠতে থাকতো তার নরম লাল রং নিয়ে।ছড়িয়ে পড়ত দিগন্তের এমাথা ওমাথায়।বাবার ধারণা ছিলো,সকালের শিশিরে ঘাসের ওপর হাঁটলে অনেক অসুখ- বিসুখ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এসময় তিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের গল্প বলতেন,গোপালভাঁড়ের গল্প বলতেন,কখনও কখনও নদী ভাঙনের গল্প বলতেন আর গ্রামগুলো কিভাবে সরে সরে নতুন চরে নতুন বসত গড়ে তুলতো, কত হাসিকান্না জড়ানো সেসব তীরবর্তী জীবন, সেসব গল্প বলতেন।
তখন হয়ত আজকের আমারই মত বাবার মনটা বিষণ্ণ হয়ে যেতো।তখনও বিষণ্ণতা কি বুঝি নি।তাই বাবার সেসব গল্পে কখনও মনোযোগ থাকতো।কখনও পাখি,ফুল,প্রজাপতি বা ফড়িং দেখতে দেখতে অমনোযোগী হয়ে যেতাম।
বাবা তখন ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কের ইনচার্জে ছিলেন। পার্কের অদূরবর্তী মাস্টারবাড়ির কোয়াটারে আমরা থাকতাম।তিন মাইল দূরের সালনা নাসিরুদ্দিন মেমোরিয়াল হাই স্কুলে পড়তাম।
সেই সব দিনে, ভোরের শীতল হাওয়া এসে আমাদের মুখে চোখে অন্য এক স্নেহের পরশ বুলিয়ে চলে যেতো অন্য ঠিকানায়।
এসব স্মৃতি খুঁজতে গত বছর বান্ধবীShogufta Reza( রেহানা)কে সংগী করে মাস্টারবাড়ি গিয়েছিলাম।সাঈদভাই বাবার আন্ডারে চাকরী করতেন।উনার বাড়িতে ঘুরে এলাম। বাস থেকে নামার পর দূর থেকে দেখতে পেলাম সেইসব কোয়াটারের প্রেত অবয়ব।
শুনতে পেলাম,এখন আর ওখানে কেউ থাকে না।কিছু বনের পশু পাখি আর সাপ বেজী কুকুর বেড়াল এসব বাড়িঘরে বসবাস করে।নানা জাতের গাছ তাদের সবুজ পল্লবে ঢেকে রেখেছে স্নেহশীল পিতামাতার মতই আমাদের স্মৃতির সে তল্লাট।ছায়া দিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব বৈভবে।
আজ(৮/৯/১৯) বাবার মৃত্যু দিনে সেসব কালশিটে পড়া স্মৃতিগুলো ভোরের হাওয়ার মতো মিষ্টি ভাব নিয়ে এসে চোখ মুখ ঝাপ্সা করে দিচ্ছে…