নতুন সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

Published By: Khabar India Online | Published On:

খবরইন্ডিয়াঅনলাইন, নয়াদিল্লিঃ লোকসভার অধ্যক্ষ শ্রী ওম বিড়লাজি, রাজ্যসভার উপ-সভাপতি শ্রী হরিবংশজি, আমার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সহযোগী শ্রী প্রহ্লাদ যোশীজি, শ্রী হরদীপ সিং পুরীজি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ, ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হওয়া অন্যান্য অনেক দেশের সংসদের অধ্যক্ষরা, এখানে উপস্থিত অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতগণ, ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সদস্যগণ, অন্যান্য সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং আমার প্রিয় দেশবাসীগণ,

আজকের দিনটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক। আজকের দিনটি ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে মাইলফলকের মতো। ভারতীয়দের দ্বারা, ভারতীয়ত্বের ভাবনায় ওতপ্রোতভাবে পরিব্যপ্ত; ভারতের সংসদ ভবনের নির্মাণের শুভারম্ভ আমাদের গণতান্ত্রিক পরম্পরার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলির অন্যতম। আমরা ভারতের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের সংসদের এই নতুন ভবন গড়ে তুলব।

বন্ধুগণ,

এর থেকে সুন্দর আর পবিত্র কী হতে পারে, যখন ভারত তার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করবে, তখন সেই উৎসবের সাক্ষাৎ প্রেরণা, আমাদের সংসদের নতুন ভবনও তৈরি হয়ে যাবে। আজ ১৩০ কোটিরও বেশি ভারতবাসীর জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের দিন, গর্বের দিন যখন আমরা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চলেছি।

বন্ধুগণ,

নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ নতুন এবং পুরাতনের সহ-অস্তিত্বের উদাহরণ। নিজের মধ্যে সময় এবং প্রয়োজনের অনুরূপ পরিবর্তন আনার এটি একটি প্রচেষ্টা। আমি নিজের জীবনের সেই মুহূর্তটি কখনই ভুলতে পারি না যখন ২০১৪ সালে প্রথমবার একজন সাংসদরূপে সংসদ ভবনে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন গণতন্ত্রের এই মন্দিরে পা রাখার আগে আমি মাথা নত করে, কপাল ঠেকিয়ে গণতন্ত্রের এই মন্দিরকে প্রণাম জানিয়েছিলাম। আমাদের বর্তমান সংসদ ভবনটি স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীন ভারত নির্মাণে তার নিজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকারের গঠন এখানেই হয়েছিল, প্রথম সংসদের অধিবেশনও এখানেই শুরু হয়েছিল। এই সংসদ ভবনে আমাদের সংবিধান রচিত হয়েছিল, আমাদের গণতন্ত্র পুনঃস্থাপন হয়েছিল। বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং অন্য বরিষ্ঠ নেতারা সেন্ট্রাল হল-এ গভীর আলাপ-আলোচনা ও আত্মমন্থনের পর আমাদেরকে এই সংবিধান উপহার দিয়েছেন। সংসদের বর্তমান ভবন স্বাধীন ভারতের প্রতিটি উত্থান-পতন, আমাদের প্রত্যেক সমস্যা, সেগুলির সমাধান, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সাফল্যের প্রতীক। এই ভবনে প্রণীত প্রতিটি আইন প্রণয়নের সময় সংসদ ভবনে অনেক বাক বিতণ্ডা, গভীর আলোচনা – এসব কিছুই আমাদের গণতন্ত্রের ঐতিহ্য।

বন্ধুগণ,

সংসদের মজবুত ইতিহাসে বাস্তবকেও স্বীকার করা ততটাই প্রয়োজন। এই ভবনের এখন প্রায় ১০০ বছর বয়স হয়ে গেছে। বিগত দশকগুলিতে এর তৎকালীন প্রয়োজন অনুভব করে নিরন্তর একে আপগ্রেড করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় অনেকবার অনেক দেওয়ালও ভাঙা হয়েছে। কখনও নতুন সাউন্ড সিস্টেম, কখনও ফায়ার সেফটি সিস্টেম, কখনও আইটি সিস্টেম, লোকসভায় বসার জায়গা বাড়ানোর জন্য দেওয়ালগুলি ভেঙে পেছনে সরানো হয়েছে। এতকিছু হওয়ার পর সংসদের এই ভবন এখন বিশ্রাম চাইছে। একটু আগে লোকসভার অধ্যক্ষ মহোদয়ও বলছিলেন কিভাবে বছরের পর বছর ধরে সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেক বছর ধরেই নতুন সংসদ ভবনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। এক্ষেত্রে আমাদের সকলের দায়িত্ব বর্তায় যে একবিংশ শতাব্দীর ভারত যেন এখন একটি নতুন সংসদ ভবন পায়। এই লক্ষ্যে আজ এই শুভারম্ভ হচ্ছে। আর সেজন্য আজ যখন আমরা একটি নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করছি, তখন বর্তমান সংসদ পরিসরের জীবনেও নতুন আয়ু যোগ করছি।

বন্ধুগণ,

নতুন সংসদ ভবনে এমন অনেক নতুন কিছু করা হচ্ছে যার ফলে সাংসদদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। তাঁদের কর্মসংস্কৃতিতে আধুনিক আদবকায়দা বাড়বে। এখন যেমন সাংসদদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁদের সংসদীয় এলাকা থেকে মানুষ আসেন, কিন্তু বর্তমান সংসদ ভবনে তাঁদের স্থান সঙ্কুলানে অনেক অসুবিধা হয়। সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয়, নাগরিকদের অসুবিধা হয়। সাধারণ মানুষ তাঁদের কোনও সমস্যার কথা, সুখ-দুঃখের কথা তাঁদের সাংসদকে বলতে চান, সেজন্য সংসদ ভবনে তেমন জায়গা নেই। ভবিষ্যতে প্রত্যেক সাংসদের এই সুবিধা থাকবে, তাঁরা নিজেদের সংসদীয় এলাকা থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে এই বিশাল সংসদীয় পরিসরের মধ্যেই কথা বলতে পারবেন। এই সংসদ চত্বরেই তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে পারবেন।

বন্ধুগণ,

পুরনো সংসদ ভবন স্বাধীনতার পর ভারতকে নতুন লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাক্ষী, আর নতুন ভবন আত্মনির্ভর ভারত নির্মাণের সাক্ষী হবে। পুরনো সংসদ ভবনে দেশের সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে কাজ হয়েছে, আর নতুন সংসদ ভবনে একবিংশ শতাব্দীর ভারতের আকাঙ্ক্ষাগুলিকে বাস্তবায়িত করা হবে। আজ যেমন ইন্ডিয়া গেটের সামনে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ স্মারক-এর জাতীয় পরিচিতি তৈরি হয়েছে, তেমনই সংসদের নতুন ভবনটিও নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলবে। দেশের জনগণ, আগামী প্রজন্ম এই নতুন ভবনকে দেখে গর্বিত হবে যে এই ভবনটি স্বাধীন ভারতে তৈরি হয়েছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিকে স্মরণ করে এর নির্মাণ হয়েছে।

আরও পড়ুন -  Satyajit Ray: জন্ম শতবার্ষিকীতে বিশেষ আয়োজন, মহারাজার

বন্ধুগণ,

সংসদ ভবনের শক্তির উৎস, এর প্রাণশক্তির উৎস হল আমাদের গণতন্ত্র। স্বাধীনতার সময় কিভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ এবং শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, তা এখন ইতিহাসের বিষয়। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, সামাজিক বৈচিত্র্য এবং অভিজ্ঞতাহীনতার মতো অনেক বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুলে এই ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছিল যে ভারতে গণতন্ত্র অসফল হবে। আজ আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমাদের দেশ সেই আশঙ্কাগুলিকে শুধু ভুল প্রমাণিত করেনি, এর বিপরীতে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রূপে এগিয়ে যেতে দেখছে।

বন্ধুগণ,

গণতন্ত্র ভারতে কেন সফল হয়েছে, কেন সফল হয়েছে, আর কেন এই গণতন্ত্রে কোনও আঁচ লাগেনি তা আমাদের প্রত্যেক প্রজন্মের মানুষের জানা-বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমরা দেখি ও শুনি, বিশ্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত ‘ম্যাগনা কার্টা’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। অনেক বিদ্বান একে গণতন্ত্রের ভিত্তিও বলেন। কিন্তু এটাও ততটাই সত্য যে ‘ম্যাগনা কার্টা’রও আগে দ্বাদশ শতাব্দীতেই ভারতে ভগবান বসবেশ্বরের ‘অনুভব মংতপম’ সফল হয়েছিল। ‘অনুভব মংতপম’ রূপে তিনি শুধুই লোক সংসদ গঠন করেননি, তাঁর দক্ষ সঞ্চালনাও সুনিশ্চিত করেছিলেন। আর ভগবান বসবেশ্বরজি বলেছিলেন –

“য়ী অনুভবা মংতপ জনসভা, নাদিনা, মত্থু রাষ্ট্রধা উন্নতিগে হাগূ,

অভিবৃদ্ধিগে পূরকারৌগী কেলশা মাদুত্থাদে!”

অর্থাৎ, ‘অনুভব মংতপ’ এমন একটি জনসভা যা রাজ্য এবং রাষ্ট্রের হিতে ও তাঁদের উন্নতিকল্পে সকলকে একজোট হয়ে কাজ করার জন্য প্রেরণা যোগায়। ‘অনুভব মংতপম’ গণতন্ত্রের একটি স্বরূপ ছিল।

বন্ধুগণ,

সেই সময়েরও আগে তামিলনাড়ুর চেন্নাই থেকে ৮০-৮৫ কিলোমিটার দূরে উত্তরা মেরুর নামক গ্রামে একটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দেখা গেছে। এই গ্রামে চোল সাম্রাজ্যের শাসনকালে দশম শতাব্দীতে পাথরে খোদাই করা তামিল লিপিতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বর্ণনা লেখা রয়েছে। আর এতে বলা হয়েছে কিভাবে প্রত্যেক গ্রামকে কুদুম্বু-তে বিভাজিত করা হত, যেগুলিকে আজ আমরা ‘ওয়ার্ড’ বলি। এই কুদুম্বুগুলির এক একজন প্রতিনিধিকে মহাসভায় পাঠানো হত। যেমন আজও হয়। এই গ্রামে হাজার বছর পুরনো যে মহাসভার আয়োজন হত, তা কিন্তু আজও সেখানে হয়।

বন্ধুগণ,

আমাদের দেশে এক হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই পাথরে খোদিত বর্ণনায় দেখা গেছে যে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত করারও ব্যবস্থা ছিল সেই সময়। আর তার নিয়ম কি ছিল? নিয়ম ছিল যে, যে জনপ্রতিনিধি তাঁর সম্পত্তির বিবরণ দেবেন না, তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কোনও আত্মীয় নির্বাচনে লড়াই করতে পারবেন না। কত বছর আগে ভাবুন। কত সুক্ষ্মভাবে সেই সময় প্রতিটি বিষয়কে ভাবা হয়েছিল, বোঝার চেষ্টা করা হয়েছিল, আর তৎকালীন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অংশ করে তোলা হয়েছিল।

বন্ধুগণ,

আমাদের দেশের প্রত্যেক কোণায় কোণায় গণতন্ত্রের এই ইতিহাসের ছাপ স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। কিছু শব্দের সঙ্গে ভারতবাসী সর্বদাই পরিচিত ছিল। সেগুলি হল – সভা, সমিতি, গণপতি, গণাধিপতি। শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে আমাদের দেশের মানুষের মন ও মস্তিষ্কে এই শব্দাবলী প্রভাবিত। অনেক শতাব্দী আগে শাক্য, মল্লম এবং ভেজ্জী-র মতো গণতন্ত্র ছিল, লিচ্ছবী, মল্লক, মরক এবং কম্বোজের মতো গণরাজ্য ছিল। মৌর্য শাসনকালে কলিঙ্গ প্রদেশও গণতন্ত্রকে প্রশাসনের ভিত্তি করে তুলেছিল। হাজার হাজার বছর আগে রচিত আমাদের বেদগুলির মধ্যে আদিতম বেদ – ‘ঋগ্বেদ’-এ গণতন্ত্রের ভাবনাকে বলা হত ‘সমজ্ঞান’। অর্থাৎ, সমূহ চেতনা।

বন্ধুগণ,

সাধারণত অন্যত্র যখন গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা হয়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচিত সদস্যগণ এবং আইনসভার গঠন প্রক্রিয়া, শাসন-প্রশাসন, গণতন্ত্রের পরিভাষা এর -এই বিষয়গুলির আশেপাশে থাকে। এরকম ব্যবস্থাকে বেশি জোর দেওয়াতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বলা হয়। কিন্তু ভারতে গণতন্ত্র হল একটি শিষ্টাচার। ভারতের জন্য গণতন্ত্র জীবনের মূল্যবোধ, জীবনযাপনের পদ্ধতি। রাষ্ট্র হল জীবনের আত্মা। ভারতের গণতন্ত্র শতাব্দীর পর শতাব্দীকালের অভিজ্ঞতা জুড়তে জুড়তে বিকশিত হওয়া একটি অতুলনীয় ব্যবস্থা। ভারতের জন্য গণতন্ত্রে জীবনের মন্ত্র যেমন আছে, জীবনের তত্ত্বও তেমনি আছে, পাশাপাশি, ব্যবস্থাতন্ত্রও আছে। সময়ের সঙ্গে এই ব্যবস্থাগুলি পরিবর্তিত হয়েছে, প্রক্রিয়াও পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের আত্মা তেমনই রয়ে গেছে। আর কেমন বিড়ম্বনা দেখুন, আজ পশ্চিমী দেশগুলির ধাঁচে আমাদের ভারতীয়দের গণতন্ত্র শেখানোর চেষ্টা করা হয়। যখন আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের গৌরবগান গাইব, তখন সেদিন দূরে থাকবে না যখন বিশ্ববাসী বলতে বাধ্য হবে, ভারতই হল গণতন্ত্রের মাতা।

আরও পড়ুন -  Bhojpuri Song: রোমান্টিকে মজেছে আম্রপালি-দীনেশ, ‘দহকে বাদান জরে জিয়া’র তালে, নেটদুনিয়ার একাংশ দেখে খুব খুশি

বন্ধুগণ,

ভারতের গণতন্ত্রের সমাহিত শক্তিই দেশের উন্নয়নকে নতুন প্রাণশক্তি জোগায়, দেশবাসীকে নতুন আত্মবিশ্বাস দেয়। বিশ্বের অনেক দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থিতি গড়ে উঠছে, সেখানে ভারতে গণতন্ত্রই নিত্যনতুন রূপে বিকশিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমরা দেখেছি যে অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এখন নির্বাচনের সময় ভোটদাতার সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। এর বিপরীতে আমরা ভারতে প্রত্যেক নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান ভোটদাতার সংখ্যা দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে, মহিলা এবং যুব সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্ব এক্ষেত্রে নিরন্তর ক্রমবর্ধমান।

বন্ধুগণ,

এই বিশ্বাস এবং আস্থার কারণ রয়েছে। ভারতে গণতন্ত্র সর্বদাই শাসনের পাশাপাশি নানা মতভেদ এবং বিরোধিতাকে মেটানোর গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ – এসব কিছুই একটি স্পন্দিত গণতন্ত্রকে ক্ষমতায়িত করে। ভিন্ন ভাবনার জন্য সর্বদা জায়গা থাকতে হবে, কিন্তু এটাও দেখতে হবে যাতে তা মূল থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। এই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের গণতন্ত্র এগিয়ে চলেছে। গুরুনানক দেবজিও বলেছিলেন –

“জব লগু দুনিয়া রহিয়ে নানক।

কিছু সুণিয়ে, কিছু কহিয়ে।।”

অর্থাৎ, যতক্ষণ সংসার থাকবে, ততক্ষণ সংবাদও চলতে থাকা উচিৎ। যতক্ষণ পৃথিবী থাকবে, ততক্ষণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বার্তালাপ চলতে থাকার সুবিধা থাকতে হবে। কিছু বলা এবং কিছু শোনা, এটাই তো বার্তালাপের প্রাণ। এটাই গণতন্ত্রের আত্মা। নীতির মধ্যে ব্যবধান থাকতে পারে, রাজনীতির মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা জনগণের সেবার জন্য – এই অন্তিম লক্ষ্য নিয়ে কোনও মতভেদ থাকা উচিৎ নয়। তর্ক-বিতর্ক সংসদের মধ্যে হোক কিংবা সংসদের বাইরে, কিন্তু প্রত্যেকের বক্তব্যেই রাষ্ট্র সেবার সঙ্কল্প এবং রাষ্ট্র হিতের প্রতি সমর্পণের ঝলক যেন সবসময় বজায় থাকে। আর সেজন্য আজ যখন নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হচ্ছে, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে গণতন্ত্র, যা সংসদ ভবনের অস্তিত্বের ভিত্তি, তার প্রতি আশাবাদ জাগিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমাদের সর্বদাই একথা মনে রাখতে হবে যে সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসা প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এই জবাবদিহিতা যেমন তাঁকে নির্বাচিত করা জনগণের প্রতি, তেমনই দেশের সংবিধানের প্রতিও। আমাদের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশকে সর্বোচ্চ স্থানে রেখে। সমস্ত ভাবনায় ও সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রহিতকে সর্বোপরি রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় সঙ্কল্পের সিদ্ধির জন্য আমাদের এক স্বরে, এক আওয়াজে উঠে দাঁড়াতে হবে। এটা অত্যন্ত জরুরি।

বন্ধুগণ,

আমাদের দেশে যখন মন্দির ভবন নির্মাণ হয়, তখন শুরুতে এর ভিত্তিপ্রস্তর কেবলই ইঁট-পাথর হয়। শ্রমিক, কারিগর, শিল্পী – সকলের পরিশ্রমে সেই ভবনের নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু যখন সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়, সেই ভবন তখন একটি মন্দির হয় ওঠে, তখন পূর্ণতা আসে, অথচ, প্রাণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে পর্যন্ত সেটি কেবলই একটি দালান ছাড়া আর কিছুই নয়।

বন্ধুগণ,

নতুন সংসদ ভবনও নির্মিত হয়ে প্রস্তুত হবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি কেবল একটি দালান হয়ে থেকে যাবে। কিন্তু এখানে কোনও মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হবে না। গণতন্ত্রের এই মন্দিরে এ ধরনের কোনও বিধি-বিধানই নেই। এই মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন এখানে নির্বাচিত হয়ে আসা জনপ্রতিনিধিরা। তাঁদের সমর্পণ, তাঁদের সেবাভাব এই মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে। তাঁদের আচার, বিচার, ভাবনা, ব্যবহার এই গণতন্ত্রের মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে। ভারতের একতা ও অখণ্ডতার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টা এই মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রাণশক্তি হয়ে উঠবে। যখন প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, বুদ্ধি, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা পূর্ণরূপে নিংড়ে দেবেন, দেশের স্বার্থে নিংড়ে দেবেন, তার অভিষেক করবেন – তখনই এই নতুন সংসদ ভবনের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে। এখানে রাজ্যসভা রয়েছে। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা ভারতের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। দেশের উন্নয়নের জন্য রাজ্যের বিকাশ, দেশের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রাজ্যগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি, দেশের কল্যাণের জন্য রাজ্যগুলির কল্যাণ – এই মৌলিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার পণ আমাদের নিতে হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আগামীকাল যাঁরা জনপ্রতিনিধি হয়ে এখানে আসবেন, তাঁদের শপথ গ্রহণের মাধ্যমেই প্রাণ প্রতিষ্ঠার এই মহাযজ্ঞে তাঁদের অবদান রাখা শুরু হয়ে যাবে। এর দ্বারা দেশের কোটি কোটি জনগণ লাভবান হবেন। সংসদের এই নতুন ইমারত এমন একটি তপোভূমি হয়ে উঠবে যেখানে দেশবাসীর জীবনে সমৃদ্ধি আনার জন্য কাজ হবে, জনকল্যাণের স্বার্থে কাজ হবে।

আরও পড়ুন -  রবি ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে প্রণাম জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী, সোশ্যাল মিডিয়াতে

বন্ধুগণ,

একবিংশ শতাব্দীকে ভারতের শতাব্দী করে তোলার জন্য আমাদের মহাপুরুষ এবং মহীয়সীদের যে স্বপ্ন ছিল, সে সম্পর্কে আমরা দীর্ঘকাল শুনে আসছি। একবিংশ শতাব্দী তখনই ভারতের শতাব্দী হয়ে উঠবে, যখন ভারতের প্রত্যেক নাগরিক নিজের দেশকে সর্বশ্রেষ্ঠ করে তোলার জন্য নিজের অবদান রাখবেন। পরিবর্তিত বিশ্বে ভারতের জন্য সুযোগ অনেক বাড়ছে। কখনও কখনও তো মনে হয় যেন সুযোগের বন্যা আসতে চলেছে। এই সুযোগগুলিকে আমাদের কোনও অবস্থাতেই, কোনভাবেই হাত থেকে বেরিয়ে যেতে দিলে চলবে না। বিগত শতাব্দীর অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাগুলি থেকে নেওয়া শিক্ষা আমাদের বারবার মনে করায় যে এখন আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। সময়কে কাজে লাগাতে হবে।

বন্ধুগণ,

একটি অত্যন্ত পুরনো এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখও আজ করতে চাই। ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দজি দেশের জনগণের সামনে আগামী ৫০ বছরের জন্য একটি আহ্বান করেছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন, আগামী ৫০ বছরে ভারতমাতার আরাধনাই যেন সর্বোপরি হয়। দেশবাসীর জন্য তিনি একটাই কাজের উপদেশ দিয়েছিলেন। সেটি হল ভারতমাতার আরাধনা করা। আর আমরা দেখেছি সেই মহাপুরুষের বাণীর শক্তি। তাঁর আহ্বানের ঠিক ৫০ বছর পরে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আজ যখন সংসদের নতুন ভবনের শিলান্যাস হচ্ছে, তখন দেশকে একটি নতুন সঙ্কল্পেরও শিলান্যাস করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককে নতুন সঙ্কল্পের শিলান্যাস করতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দজির সেই আহ্বানকে মনে রেখে আমাদের এই সঙ্কল্প নিতে হবে। সেই সঙ্কল্প হবে – ভারত সর্বোপরি, ভারত সবার আগে! আমরা শুধু এবং শুধুই ভারতের উন্নতি, ভারতের উন্নয়নকেই নিজেদের আরাধনার বিষয় করে তুলব। আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত দেশের শক্তি বাড়াবে। আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত একই দাড়ি-পাল্লায় মাপা হবে। আর সেই দাড়ি-পাল্লা হল দেশের হিত সর্বোপরি, দেশের হিত সবার আগে। আমাদের প্রতিটি নির্ণয় বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হিতে গ্রহণ করতে হবে।

বন্ধুগণ,

স্বামী বিবেকানন্দজি ৫০ বছরের কথা বলেছিলেন। আমাদের সামনে ২৫-২৬ বছর পরই ভারতের স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তি হতে চলেছে। যখন দেশ ২০৪৭ সালে তার স্বাধীনতার শততম বর্ষে প্রবেশ করবে তখন আমাদের দেশ কেমন হবে, আমাদের দেশকে কতদূর নিয়ে যেতে হবে। এই ২৫-২৬ বছর আমাদের কিভাবে উঠে-পড়ে কাজে লাগতে হবে সেজন্য আমাদের আজ সঙ্কল্প নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। যখন আমরা আজ সঙ্কল্প নিয়ে দেশহিতকে সর্বোপরি রেখে কাজ করব, তখন দেশের বর্তমানই শুধু নয়, দেশের ভবিষ্যতও উন্নততর করে তুলব। আত্মনির্ভর ভারতের নির্মাণ, সমৃদ্ধ ভারতের নির্মাণ এখন আর থেমে থাকবে না। কেউ থামাতে পারবে না।

বন্ধুগণ,

আমরা ভারতবাসী যেন এই শপথ গ্রহণ করি, আমাদের জন্য দেশহিতের থেকে বড় আর কিছু হবে না। আমরা ভারতের জনগণ যেন এই শপথ গ্রহণ করি, আমাদের জন্য দেশের চিন্তা নিজের চিন্তা থেকেও বড় হবে। আমরা ভারতের মানুষ যেন এই শপথ নিই, আমাদের জন্য দেশের একতা ও অখণ্ডতা থেকে বড় কিছু হবে না। আমরা ভারতের জনগণ যেন শপথ নিই, আমাদের দেশের সংবিধানের মান-মর্যাদা এবং তার প্রত্যাশা পূর্তিকে জীবনের সবচাইতে বড় লক্ষ্যে পরিণত করতে হবে। আমাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাবনা সর্বদা মনে রাখতে হবে। তিনি বলতেন,

“একতা উৎসাহ ধরো, জাতীয় উন্নতি করো, ঘোষুক ভুবনে সবে ভারতের জয়।”

অর্থাৎ, একতার উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, প্রত্যেক নাগরিকের উন্নতি করতে হবে, তবেই গোটা বিশ্বে ভারতের জয়জয়কার হবে!

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের সংসদের নতুন ভবন আমাদের সকলকে একটি নতুন আদর্শ গড়ে তোলার প্রেরণা জোগাবে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বস্ততা নিরন্তর আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এই কামনা রেখে আমার বক্তব্যকে এখানেই বিরাম দিচ্ছি। আর ২০৪৭-এর সঙ্কল্প নিয়ে সমগ্র দেশবাসীকে এগিয়ে চলার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সূত্র – পিআইবি।