৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাকসন্ধ্যায় ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ প্রদত্ত জাতির উদ্দেশে ভাষণের বাংলা রূপান্তর

Published By: Khabar India Online | Published On:

খবরইন্ডিয়াঅনলাইন, নয়াদিল্লিঃ আমার প্রিয় দেশবাসীগণ,

নমস্কার |

১. ৭৪তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক-সন্ধ্যায় দেশে-বিদেশে বসবাসকারী ভারতের সমস্ত মানুষকে অনেক-অনেক অভিনন্দন এবং অগণিত শুভেচ্ছা! ১৫ই আগস্ট আমরা সবাই ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবসের সমারোহে অংশগ্রহন করে এবং দেশভক্তিপূর্ণ গান শুনে উদ্দীপনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠি | আমাদের নবীন প্রজন্মের জন্য এই স্বাধীনতার গৌরবময় অধ্যায়কে উপলব্ধি করার দিন এটা | এই উপলক্ষে আমরা আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বলিদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে থাকি| তাঁদের বলিদানের শক্তিতেই আমরা সবাই আজ এক স্বাধীন দেশের বাসিন্দা !

২. আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শের ভিত্তিভূমিতেই আধুনিক ভারতের নির্মান কাজ চলছে | আমাদের দূরদর্শী দেশ নায়কেরা নিজেদের বিভিন্ন ভাবনা-চিন্তাকে জাতীয়তাবাদের এক সুতোয় গেঁথে নিয়েছিলেন |তাঁদের সমবেত প্রতিজ্ঞা ছিল দেশকে দমন-পীড়ন চালানো বিদেশী শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করানো এবং ভারত মায়ের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করা | তাঁদের কার্যকলাপের মাধ্যমেই আধুনিক দেশ হিসেবে ভারতের পরিচিতির বিষয়টি মূর্ত রূপ পেয়েছিল |

৩. আমরা সৌভাগ্যবান যে মহাত্মা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথ প্রদর্শক ছিলেন | তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন সন্ন্যাসী এবং রাজনৈতিক নেতার যে সমন্বয় দেখা যায়, তা ভারতের মাটিতেই সম্ভব | সামাজিক সংঘাত, আর্থিক সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নাজেহাল আজকের পৃথিবী গান্ধীজির দেখানো পথেই সমাধান খুঁজে পায়। | সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা আমাদের গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র | গান্ধীজিকে নিয়ে আমাদের যুব প্রজন্মের মধ্যে এত জিজ্ঞাসা এবং উৎসাহ দেখে আমি খুবই আনন্দিত |

আমার প্রিয় দেশবাসীগণ,

৪. এবছর স্বাধীনতা দিবসের উৎসব উদযাপনে অন্য বছরের মত জাঁকজমক থাকবে না | এর কারণটা স্পষ্ট | গোটা বিশ্ব এক এমন মারাত্মক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে যা জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতিকর আঘাত হেনেছে | সমস্ত ধরনের গতিবিধিকে বাধার মুখে ঠেলে দিয়েছে | এই বিশ্ব মহামারীর কারণে আমাদের সবার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে |

৫. এটা খুবই আশ্বস্ত হবার মত কথা যে, এই সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরে সময় থাকতেই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো |এইধরনের অসাধারণ পদক্ষেপের জোরেই জনঘনত্ব এবং বিচিত্র পরিস্থিতিযুক্ত আমাদের এই বিশাল দেশে এই সমস্যা মোকাবিলা করা হচ্ছে | রাজ্য সরকারগুলিও স্থানীয় পরিস্থিতি অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে |সাধারণ মানুষও সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন | এই প্রয়াসের জন্যই আমরা বিশ্বব্যাপী মহামারীর ভয়াবহতার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং অনেক ব্যাপক সংখ্যায় সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষায় সাফল্য অর্জন করেছি | এটা গোটা বিশ্বের সামনে এক অনুকরণীয় উদাহরণ বলা যেতে পারে |

৬. দেশ সেই সমস্ত চিকিৎসক , নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে ঋণী, যাঁরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে সামনের সারির যোদ্ধা| দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের মধ্যে অনেক যোদ্ধাই এই মহামারী মোকাবিলা করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বলি দিয়েছেন | তাঁরা আমাদের দেশের আদর্শ সেবাপরায়ন যোদ্ধা |এই করোনা যোদ্ধাদের যতই প্রশংসা করা হোক না কেন, তা অনেক কম | এই সমস্ত যোদ্ধা নিজেদের কর্তব্য পালনের সীমানা ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচান এবং জরুরী পরিষেবা প্রাপ্তির বিষয়টি সুনিশ্চিত করেন | এমন চিকিৎসক , স্বাস্থ্যকর্মী, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্য , পুলিশ কর্মী , সাফাই কর্মচারী, সরবরাহকারী কর্মী, পরিবহন, রেল এবং বিমান কর্মী, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী , সরকারী কর্মচারী, সমাজসেবী সংগঠন এবং দরাজ মনের মানুষ নিজেদের সাহস ও নিঃস্বার্থ সেবার অনুপ্রেরনাদায়ক উদাহরণ তৈরী করছেন | যখন গ্রাম এবং শহরে কাজকর্ম থমকে যায় , রাস্তা সুনসান হয়ে যায় তখন নিজেদের নিরন্তর পরিশ্রমে এই করোনা যোদ্ধারা এটা সুনিশ্চিত করেন যে, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও ত্রান, জল ও বিদ্যুৎ , পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুধ এবং সবজি, খাবার এবং নিত্য ব্যবহারের পণ্য , ঔষধ এবং অন্য জরুরি পরিষেবা যেন অব্যাহত থাকে | তাঁরা নিজেদের জীবনকে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেন যাতে আমরা সবাই এই মহামারী থেকে সুরক্ষিত থাকি, আমাদের জীবন ও জীবিকা দু’টোই স্বাভাবিক ধারায় বইতে থাকে |

৭. এর মধ্যেই আবার পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায় ঘুর্নিঝড় ‘আম্ফান’এ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় | এর ফলে আমাদের সমস্যা আরও বেড়ে যায় | এই বিপর্যয়ে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি যতদূর সম্ভব কমানোর লক্ষ্যে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী , কেন্দ্র ও রাজ্য সমূহের এজেন্সিগুলি এবং সচেতন মানুষ একজোট হয়ে যে প্রয়াস চালিয়েছেন তাতে বেশ সুফল পাওয়া গেছে | দেশের উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব প্রান্তের রাজ্যগুলিতে দেশবাসীকে বন্যার প্রকোপ সইতে হচ্ছে | এই ধরনের দুর্যোগের মধ্যে সমাজের সমস্ত অংশের মানুষ একজোট হয়ে বিপন্ন মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন |

আরও পড়ুন -  শেষ হবে না ব্যাটারি, যত খুশি ইউজ করতে পারবেন, নোকিয়ার নতুন এই স্মার্টফোন

আমার প্রিয় দেশবাসীগণ,

৮. এই মহামারীর সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত নেমে এসেছে গরিব এবং দিন খেটে খাওয়া মানুষের ওপর | সংকটের এই সময়ে তাঁদের সাহায্য করার জন্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি অনেক জনকল্যানকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে | ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’ চালু করে সরকার কোটি কোটি মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করেছে , যাতে মহামারীর কারণে চাকরি হারানো , এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া তথা জীবনের সর্বস্বান্ত হওয়ার কষ্ট কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যায় |সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে | এই পদক্ষেপসমূহে কর্পোরেট ক্ষেত্র, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে |

৯. কোন পরিবারের সদস্যকে যেন খালি পেটে না থাকতে হয় , সেজন্য দুস্থদের বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে | বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বন্টনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই অভিযানকে ২০২০-র নভেম্বর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে | এই অভিযানে প্রতি মাসে প্রায় ৮০ কোটি মানুষের রেশন সামগ্রীর সহজলভ্যতা সুনিশ্চিত হয়েছে | যাঁদের রেশন কার্ড আছে তাঁরা যেন দেশের যে কোন প্রান্তেই নিজের রেশন সামগ্রী তুলতে পারেন সেজন্য সমস্ত রাজ্যকে ‘ওয়ান নেশন- ওয়ান রেশন কার্ড ‘ যোজনায় নিয়ে আসা হচ্ছে |

১০. বিশ্বের যেকোন জায়গায় সমস্যা সংকুল অবস্থায় থাকা আমাদের দেশবাসীকে সাহায্য করার দায়বদ্ধতা থেকে সরকার ‘বন্দে ভারত মিশন’-এ দশ লক্ষের বেশি ভারতীয়কে স্বদেশে ফিরিয়ে এনেছে | ভারতীয় রেল এই সমস্যাসংকুল সময়ে জরুরি রেল পরিষেবা অব্যাহত রেখে পণ্য এবং মানুষের যাতায়াত চালু রেখেছে|

১১. নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি আস্থা রেখে আমরা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যান্য দেশের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি | অন্যান্য দেশের অনুরোধে ঔষধের ব্যবস্থা করে আমরা আরও একবার প্রমান করে দিয়েছি যে, ভারত সংকটের সময় গোটা বিশ্বের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় | আঞ্চলিক ও বিশ্ব পর্যায়ে মহামারী মোকাবিলায় কার্যকর কৌশল তৈরীর ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে | জাতিসঙ্ঘ সুরক্ষা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যপদের জন্য সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনে পাওয়া ব্যাপক সমর্থন ভারতের প্রতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিবাচক ভাবনারই প্রমান |

১২. ভারতের এই ঐতিহ্য রয়েছে যে , আমরা শুধু নিজের জন্য বাঁচি না, বরং গোটা বিশ্বের কল্যানে আমরা সক্রিয় থাকি | ভারতের আত্ম নির্ভরতার অর্থ নিজেকে সক্ষম করে তোলা | পৃথিবীর অন্য প্রান্তের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরী বা দূরত্ব বাড়ানো নয় | বরং এর এমন মানে করা যায় যে, ভারত বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় সামিলও হবে , আবার নিজেদের বিশেষ পরিচিতিও অব্যাহত রাখবে |

প্রিয় দেশবাসীগণ ,

১৩. আজ গোটা বিশ্ব ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ, ‘সমস্ত বিশ্বই একটি পরিবার’ এই ভাবনাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে , এই উচ্চারণ আমাদের সংস্কৃতিতে অনেক আগেই করে রাখা হয়েছে | কিন্তু, আজ যখন গোটা বিশ্বে আমাদের সামনে এসে হাজির হওয়া সবচেয়ে বড় সমস্যার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াইয়ে সামিল হওয়ার প্রয়োজন বড়ো হয়ে উঠেছে , সেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ তাদের সম্প্রসারণমূলক তৎপরতাকে চালাকি করে বাস্তবায়িত করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে | সীমান্ত সুরক্ষার কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমাদের বীর সেনানীরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন | ভারত মায়ের এই সুপুত্ররা দেশের গৌরব অটুট রাখার জন্য বেঁচেছিলেন এবং সেই গৌরব রক্ষা করতে গিয়েই শহীদ হলেন। |গোটা দেশ গালওয়ান উপত্যকার শহীদদের প্রনাম জানায় |প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাবনা রয়েছে | তাঁদের শৌর্য এটাই দেখিয়েছে যে, আজ পর্যন্ত যদিও আমরা শান্তির প্রতি আস্থাশীল, কিন্তু যদি কেউ অশান্তি তৈরির প্রয়াস চালায় তাহলে তাকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে | আমাদের সীমান্ত রক্ষাকারী এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারী সশস্ত্র বাহিনী , পুলিশ তথা আধা সেনা বাহিনীকে নিয়ে আমরা গর্বিত |

আরও পড়ুন -  প্রশ্ন তুললেন শেবাগ, ভারতের বিশ্বকাপ দল নিয়ে

১৪. আমি এটা বিশ্বাস করি যে, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন ও জীবিকা উভয়ের সুরক্ষায় মনযোগ দেওয়া জরুরি | আমরা চলতি সংকটকে সবার কল্যানে, বিশেষ করে কৃষক ও ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় সংস্কার এনে অর্থব্যবস্থাতে পুনরায় গতি সঞ্চারের সুযোগ হিসেবে দেখছি | কৃষি ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সংস্কার সাধিত হয়েছে | এখন কৃষক বিনা বাধায় দেশের যেকোন জায়গায় নিজের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করে তার সর্বাধিক মূল্য পেতে পারেন |কৃষকদের নিয়মের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত করার জন্য ‘জরুরি পণ্য সংক্রান্ত নিয়মে’ সংশোধনী আনা হয়েছে | এতে কৃষকদের আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সুবিধা হবে |

আমার প্রিয় দেশবাসী,

১৫) ২০২০ সালে আমরা সবাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি| এক অদৃশ্য ভাইরাস এই মিথকে ভেঙ্গে দিয়েছে যে, প্রকৃতি মানুষের অধীন| আমি মনে করি সঠিক পথ অনুসরণ করে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে জীবনশৈলী গ্রহণ করার সুযোগ মানুষের সামনে এখনও রয়েছে| জলবায়ু পরিবর্তনের মতই এই মহামারীও একটি চেতনা জাগিয়েছে যে, বিশ্বের সমস্ত মানুষের ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত| আমার মতে বর্তমান সময়ে ‘অর্থকেন্দ্রিক সহযোগিতার’ চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘মানব-কেন্দ্রিক সহযোগিতা’| এই পরিবর্তন যত বেশি ব্যাপক হবে, মানবতার তত বেশি ভালো হবে| একবিংশ শতাব্দীকে এমন এক শতাব্দী হিসেবে মনে রাখতে হবে, যখন মানবতা সমস্ত রকম ভেদাভেদ দূরে সরিয়ে ধরিত্রী মায়ের রক্ষার জন্য একজোট হয়ে প্রয়াস করেছে|

১৬) দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে যে, প্রকৃতি-রূপী জননীর দৃষ্টিতে আমরা সবাই এক সমান| অর্থাৎ, নিজের জীবনরক্ষা আর বিকাশের জন্য মূলত আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষের উপর নির্ভরশীল| মানব সমাজের সৃষ্ট কৃত্রিম ভেদাভেদকে করোনা ভাইরাস মানে না| এর দ্বারা এই বিশ্বাস সুদৃঢ় হয় যে, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সমস্ত প্রকার কুসংস্কার আর সীমানা থেকে আমাদেরই উপরে উঠে আসতে হবে| ভারতবাসীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা আর করুণার মনোভাব দেখা যায়| আমাদেরকে নিজেদের আচরণে এই সদগুণকে আরও বেশি সন্নিবিষ্ট করতে হবে| তখনই আমরা সবার জন্য আরও উন্নত ভবিষ্যতের নির্মাণ করতে পারবো|

১৭) তৃতীয় শিক্ষাটি স্বাস্থ্য-পরিষেবাকে আরও শক্তিশালী করার সঙ্গে যুক্ত| সর্বজনীন হাসপাতাল আর গবেষনাগারগুলি কোভিড-নাইন্টিন এর মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা গ্রহণ করছে| সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য গরিব মানুষদের এই মহামারীর মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে| সেজন্য এইসব সর্বজনীন স্বাস্থ্য-পরিষেবাকে আরও অধিক বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করতে হবে|

১৮) চতুর্থ শিক্ষা হচ্ছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সম্পর্কিত| এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর ফলে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে আরও দ্রুত বিকশিত করার প্রয়োজনের দিকে আরও অধিক মনোযোগ এসেছে| লকডাউন এবং তার পরে ক্রমান্বয়ে আনলকের প্রক্রিয়ার সময়ে প্রশাসন, শিক্ষা, ব্যবসা, অফিসের কাজকর্ম আর সামাজিক যোগাযোগের কার্যকর মাধ্যম হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচার প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা হয়েছে| এই মাধ্যমের সহযোগিতায় প্রত্যেক ভারতীয়ের জীবন এবং কাজকর্মকে পুনরায় শুরু করার উদ্দেশ্যকে একসঙ্গে পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে| কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোর দফতর নিজেদের কাজকর্ম করার জন্য বিশেষ ভাবে ভার্চুয়াল ইন্টারফেস ব্যবহার করছে| ন্যায়বিচার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকরা ভার্চুয়াল কোর্টের পদ্ধতি গ্রহন করেছেন| ভার্চুয়াল কনফারেন্সের আয়োজন করার জন্য এবং অন্যান্য কাজকর্ম করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ভবনেও আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করছি| আই.টি. এবং সম্প্রচারের উপকরণের সহযোগিতায় ডিসটেন্স এডুকেশন অর্থাৎ ই-লার্নিং-এর ক্ষেত্রে উৎসাহ এসেছে| নানা ক্ষেত্রে এখন ঘর থেকেই কাজ করার প্রচলন হয়ে গেছে| প্রযুক্তির সহায়তায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ স্তর থেকে অনেক বেশি কাজকর্ম করে অর্থব্যবস্থার গতি প্রদান করা হয়েছে| এভাবেই আমরা এই শিক্ষাও পেয়েছি যে, প্রকৃতির সংগে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমাদের অস্তিত্ব আর অগ্রগতির ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে সুবিধা হবে|

১৯) এইসব শিক্ষা সমগ্র মানব জাতির জন্য উপযোগী প্রমাণিত হবে| আজকের যুব সম্প্রদায় এই বিষয়টিকে অনেক ভালোভাবে রপ্ত করেছে| আর আমি বিশ্বাস করি যে, এই যুব সম্প্রদায়ের হাতে ভারতের ভবিষ্যত সুরক্ষিত আছে|

২০) এই পর্যায় আমাদের সবার জন্যই কঠিন সময়| আমাদের নবীনদের সমস্যা তো আরও অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে| শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার ফলে আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে হয়ত, আর এখন তাঁরা নিজেদের স্বপ্ন আর আকাংক্ষা নিয়ে চিন্তিত| আমি তাদেরকে বলতে চাই যে, এই সংকট থেকে আমরা বিজয় লাভ করবো| আর সেজন্য নিজেদের স্বপ্নকে পূরণ করার প্রচেষ্টায় তরুণ-তরুনীদের নিরন্তর লেগে থাকা উচিত| ইতিহাসে এ ধরনের প্রেরণাদায়ক অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে বড় বড় সংকট আর প্রতিকূলতার পরে সামাজিক, আর্থিক আর জাতীয় পুনর্নির্মাণের কাজ নতুন শক্তি দিয়ে শুরু করা হয়েছে| আমার বিশ্বাস যে, আমাদের দেশ আর যুব সমাজের ভবিষ্যত উজ্জ্বল|

আরও পড়ুন -  জুন মাসে জিএসটি বাবদ রাজস্ব সংগ্রহ; আলোচ্য মাসে রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ ৯০ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা

২১) আমাদের ছেলেমেয়ে ও নবীনদের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষা প্রদান করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে| আমার বিশ্বাস যে, এই নীতি থেকে গুণমান সম্পন্ন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা বিকশিত হবে, যা ভবিষ্যতে আসা প্রতিকূলতাকে সুযোগে পরিণত করে নতুন ভারতের পথ প্রশস্ত করবে| আমাদের যুব সমাজের আগ্রহ ও প্রতিভা অনুসারে নিজের নিজের বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকবে| তাঁরা তাঁদের দক্ষতার বিকাশ করার সুযোগ পাবেন| আমাদের আগামী প্রজন্ম এই যোগ্যতার শক্তি দিয়ে শুধু যে নিজেদের রোজগার পেতেই সফল হবে তা নয়, বরঞ্চ অন্যের জন্যও রোজগারের সুযোগ তৈরি করবে|

২২) জাতীয় শিক্ষানীতি এক দূরদর্শী, সুদূরগামী নীতি| এর ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘অন্তর্ভুক্তি’, ‘উদ্ভাবনা’ এবং ‘প্রতিষ্ঠানের’ সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হবে| নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে মাতৃভাষায় পড়াশোনার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে| ফলস্বরূপ, শিশুদের মন সহজ সরলতার সঙ্গে প্রস্ফুটিত পল্লবিত হতে পারবে| একই সংগে এর ফলে ভারতের সমস্ত ভাষা এবং ভারতের একতা আরও শক্তিশালী হবে| কোনো রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার জন্য দেশের নবীনদের ক্ষমতায়ণ হওয়া জরুরি| আর জাতীয় শিক্ষানীতি এক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ|

প্রিয় দেশবাসী,

২৩) সবেমাত্র দশদিন আগে অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মভূমিতে মন্দির নির্মানের শুভ আরম্ভ হয়েছে এবং দেশবাসীর এতে গৌরবের অনুভুতি হয়েছে| দেশবাসী দীর্ঘ সময় ধরে ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন এবং দেশের বিচার ব্যবস্থায় সবসময় আস্থা রেখেছেন| শ্রীরাম জন্মভূমির সঙ্গে যুক্ত আইনি সমস্যাকেও যথোপযুক্ত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছে| সমস্ত পক্ষ ও দেশবাসী শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন এবং শান্তি, অহিংসা, প্রেম ও সৌহার্দ্য-এর মূল্যবোধকে বিশ্বের সামনে পুনরায় নিয়ে এসেছেন| সেজন্য আমি সমস্ত দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাই|

আমার প্রিয় দেশবাসী,

২৪) ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করলো, তখন কিছু মানুষ এই আশংকা করেছিলেন যে, গণতন্ত্রের প্রয়োগ আমাদের সফল হবে না| তাঁরা আমাদের প্রাচীন পরম্পরাগুলি এবং বহুমাত্রিক বিবিধতাকে আমাদের রাষ্ট্র-ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের পথে বাধা বলে মনে করতেন| কিন্তু আমরা আমাদের পরম্পরা আর বিবিধতাকে সবসময় আমাদের শক্তি মনে করে সেগুলোর উত্সাহ বর্ধন করেছি| আর সেজন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র এত জীবন্ত| মানবতার ভালোর জন্য ভারতকে অগ্রণী ভুমিকা গ্রহণ করতে হবে|

২৫) আপনারা সমস্ত দেশবাসী, এই বৈশ্বিক মহামারীর মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব আর ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন, তার প্রশংসা গোটা বিশ্ব জুড়ে হচ্ছে| আমার বিশ্বাস যে, আপনারা সবাই এভাবেই সতর্কতা ও দায়িত্বপালন বজায় রাখবেন|

২৬) আমাদের কাছে বিশ্বকে দেওয়ার মত অনেক কিছু রয়েছে| বিশেষ করে বৌদ্ধিক, আধ্যাত্মিক আর বিশ্ব-শান্তির উপযোগী| এই মানব-মঙ্গলের ভাবনা থেকে আমি প্রার্থনা করছি যে, সমস্ত বিশ্বের কল্যাণ হোক:

‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ, সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ|

সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিত দুঃখভাগ ভাবেত||’

অর্থাৎ,

‘সবাই সুখি থাকুক, সবাই রোগ-মুক্ত থাকুক, সমস্ত মানুষ ভালো কাজে মন দিক, আর কাউকেই যেন দুঃখ ভোগ করতে না হয়|

সম্পূর্ণ বিশ্বের কল্যাণের এই বার্তা, মানবতার জন্য ভারতের এক অনন্য উপহার|

২৭) আরও একবার আপনাদের সবাইকে চুয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের অভিনন্দন জানিয়ে, আপনাদের সবার সুস্বাস্থ্য এবং সুন্দর ভবিষ্যতের কামনা করছি|

ধন্যবাদ…

জয় হিন্দ|| সূত্র – পিআইবি।