‘ যাত্রা ‘ – বাংলার এক অবলুপ্তপ্রায় শিল্প !

Published By: Khabar India Online | Published On:

খবরইন্ডিয়াঅনলাইনঃ

‘ যাত্রা ‘ – বাংলার এক অবলুপ্তপ্রায় শিল্প

রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখিকা।

রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়

সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলার সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত গর্বের বিষয়। সে সাহিত্য হোক অথবা পুরাকীর্তি। সবেতেই বাংলার নিজস্বতা বজায় ছিল।সেই সংস্কৃতিরই অন্যতম নিদর্শন যাত্রাপালা।গ্রাম বাংলার একটি বিনোদনের উপকরণ ছিল যাত্রাপালা।শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তো বলেই গেছেন যে, থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়,যাত্রাপালাও তার মধ্যেই পড়ে।

গ্রামের নানা উৎসব অনুষ্ঠান বা মেলা যেমন চড়ক, দুর্গাপূজা, শিবরাত্রি উপলক্ষে সাধারণত যাত্রার আয়োজন হয়।অনেক সময় আবার গ্রামের মাতব্বরদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে কে কত ভালো পালা আনতে পারে সেই নিয়ে।তবে এই সবই এখন অতীত। বর্তমানে যাত্রা শিল্প বেশ দুরাবস্থার মধ্যে আছে।তবে সেই আলোচনায় যাবার আগে একবার দেখে নিই তার সোনালী দিনগুলো। গ্রামের সাধারণ মানুষও অনেক সময় নিজেরাই যাত্রাদল বেঁধে অভিনয় করতো।তাতে অবশ্যই পুরুষদের একচেটিয়া ছিল।সাধারণ বাড়ীর মহিলারা অভিনয় করবেন এ ভাবাই যেত না।মজা ছিল এই যে, অনেকসময় পুরুষরাই সেজেগুজে মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করতেন।বিখ্যাত দলগুলিতেও যে এই রেওয়াজ ছিল,তার প্রমান বিখ্যাত যাত্রা জগতের বিখ্যাত চপলরানী।শ্রদ্ধেয় পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি ছায়াছবিও আছে এই প্রসঙ্গে। পরে পরে অবশ্য মহিলাদের অনুপ্রবেশ ঘটে যাত্রায়। শখের যাত্রা দলগুলিও ‘ফিমেল’ ভাড়া করা আরম্ভ করে।

আরও পড়ুন -  Swastika Dutta: স্বস্তিকার নাচের ভিডিও চুপিসাড়ে ফ্রেমবন্দি করলেন অন্য একজন, কে ? পোস্ট ভাইরাল

সেইসময় যাত্রাশিল্পীরাও যথেষ্ট বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিলেন,বিশেষ করে গ্রামের মানুষের মধ্যে। সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রীদের যে ভীড় বর্তমানে যাত্রায় দেখা যায়,তখন তা খুব একটা চোখে পড়তো না।বরং বছরের প্রথমেই শিল্পীদের সঙ্গে যাত্রা দলের যে চুক্তি হতো, তাতে অনেক সময়েই ময়দানের দুই প্রখ্যাত ক্লাবের মতোই দল বদল নিয়ে তুলকালাম চলতো।সাধারণত রথের দিন এই চুক্তিপর্ব সম্পন্ন হতো।গ্রাম থেকে বাবুরা যেতেন শহরে,যাত্রাদলের বায়না সেরে রাখতে।বেশ কয়েকমাস আগে থেকে বায়না না করলে যাত্রার ‘ডেট’ পাওয়াই মুস্কিল হতো।সে ছিল যাত্রার স্বর্ণযুগ।

বিশাল মাঠের মধ্যে স্টেজ বাঁধা শুরু হতো, বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই। চারিদিক খোলা মঞ্চ ব্যবহার হয় সাধারণত যাত্রার ক্ষেত্রে।পৌরাণিক পালার ক্ষেত্রে একসঙ্গে চারটে মঞ্চও ব্যবহার হতো।একটা সময় যাত্রা মানেই ছিল ধর্মীয়,ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক পালা,সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাহিদা বাড়ে সামাজিক যাত্রাপালার।সমসাময়িক বহু বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হতে থাকে পালা।

যাত্রার সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক ছিল গভীর।মঞ্চের পাশেই খোল, করতাল,হারমোনিয়াম, তবলা, সানাই নিয়ে থাকতেন একদল বাদ্যকর। যাত্রার প্রথম ঘন্টা পড়লেই শুরু হতো বাদ্য-বাজনা।গানের গলা মিষ্টি হলে দলে অভিনেতাদের কদর যেত বেড়ে।

গ্রামের মানুষের উন্মাদনাও কম ছিল না যাত্রাকে ঘিরে।কোথাও যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হলে সেখানের মানুষের মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে যেত। মাইকে করে যাত্রার প্রচারে বেড়িয়ে পড়তো স্থানীয় ক্লাব থেকে গাড়ি করে।আশেপাশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে যাত্রার প্রচার হবে,সেইসঙ্গে টিকিট বিক্রিও হবে।আগে কিনলে কিছুটা কমে পাওয়া যাবে।
“আসছে আসছে আসছে কলিকাতার বিখ্যাত নট্টকোম্পানির এবছরের ‘সেরা যাত্রাপালা’ বলে প্লুতস্বরে পালার নাম।নামগুলিও বেশ চমকদার হতো।ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় রচিত এরকমই কয়েকটি বিখ্যাত যাত্রাপালা হলো- ‘থানায় যাচ্ছে ছোটবৌ’ ‘মা আসামী ছেলে জজ’ প্রভৃতি।
মাইলের পর মাইল হেঁটে এক গ্রাম থেকে আরেকগ্রামে যাত্রা দেখতে যেত মানুষ। অনেক সময়েই চেয়ারের ব্যবস্থাও থাকত না,কিন্তু মাটিতে পাতা ঢালাও চটে বসেই মানুষ যাত্রার স্বাদ নিতে কুন্ঠা করতো না।

আরও পড়ুন -  তিনবার ভূমিকম্প আধ ঘণ্টার ব্যবধানে

সামাজিক যাত্রাপালায় সাধারণত দুজন নায়িকা থাকত,একজন বেশ সিধেসাধা প্রকৃতির আর একজন দুষ্টুমিষ্টি গোছের আর একজন ‘গায়ক নায়ক’ আর ভিলেন। বাকিরা নানা চরিত্র শিল্পী। এছাড়া বিবেক বলেও একটি বেশ জনপ্রিয় চরিত্র থাকত।

এক জায়গায় যাত্রা সেরে দলের বাসে চেপে অন্য জায়গায় পৌঁছাত দলের শিল্পীরা তবে নায়ক নায়িকারা সাধারণত আসতেন শো শুরুর ঠিক আগে আগে,আলাদা গাড়ীতে।যাত্রা শিল্পীদের থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে যে গাঁয়ে যাত্রা হতো, সেখানে যেন উৎসবের পরিবেশ তৈরী হতো।এখন অবশ্য যাত্রার সেই রমরমা একেবারেই নেই।টিভির নিত্য নতুন চ্যানেল,ইন্টারনেটের ব্যবহার যাত্রার আকর্ষণকে অনেকদিন আগেই ম্লান করে দিয়েছে।তারো আগে পাড়ায় পাড়ায় ভিডিও শো এসে যাত্রার অবস্থা কিছুটা সঙ্গীন করেই ছিল।ছোটখাট পুজো-পার্বনে যে টুকটাক পালা হয়,স্থানীয় যাত্রা শিল্পীদের ভাষায় তা মাছ-ভাতের শো হিসাবে পরিচিত। এই রকম অদ্ভুত নামকরণের কারন জানিতে চাওয়ায় বিখ্যাত পালাকার ও গীতিকার সমীর ঘোষ জানালেন-” এই টুকটাক শো করে,সামান্য যাতায়াত খরচ আর খাওয়া -দাওয়া ছাড়া কিছুই মেলেনা শিল্পীদের, তাই এই সব শো মাছ-ভাতের শো নামেই পরিচিত। ” হুগলীর কামারপুকুর নিবাসী এই অভিজ্ঞ পালাকার ক্ষেদের সঙ্গে আরো জানিয়েছেন-বর্তমানে সিনেমা ও সিরিয়ালের শিল্পীদের অনুপ্রবেশ ঘটায় যাত্রার পূর্বের কৌলীন্য নষ্ট হয়েছে।”
তবে যাত্রার কফিনে শেষ পেরেকটি বোধহয় বিধেঁছে করোনা।আজ প্রায় দুই বছর, করোনাকালীন পরিস্থিতির কারনে সমস্ত শো বন্ধ হয়ে গেছে পুরোপুরি।এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন।অনেকেই বাধ্য হয়েই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা।

আরও পড়ুন -  দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব

একদিন হয়তো পৃথিবী এই করাল জীবানুর হাত থেকে মুক্ত হবে,মানুষ আবার নিশ্চিন্তে ভীড় জমাবে রাস্তায়, মাতবে উৎসবে কিন্তু যাত্রা শিল্প কী পারবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে,নিজের হারিয়ে যাওয়া কৌলীন্য ফিরে পেতে।আবার কী আসর জমে উঠবে বাদ্যে-গানে।জানি না,এর সঠিক উত্তর তো একমাত্র সময়ই দিতে পারবে।।