“একটু উষ্ণতার ছোঁয়া”
লেখিকাঃ সোহিনী ঘোষ।
বাবার মৃত্যুর পর অনামিকা কাউকেই তেমন করে আপন করতে পারেনি। সব ভালোলাগার মুহূর্তগুলোতেই তার বাবার কথা মনে পড়ে। মন খুলে যেন আনন্দ হাসি আসে না। হঠাৎই তার বাবার বন্ধু অনিমেষ যাকে সে কাকু বলে ডাকে সেই কাকু তাকে সঙ্গ দেয়, অনামিকার সাথে উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করে, গান শোনায়, মজার গল্পও করে। যেন সে তার বাবাকে পায় তার মধ্যে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে থাকে তার জীবন। পরিবারের সবার সাথে বেড়াতে যায় সেখানে অনিমেষও যায়। যেন উন্মুক্ত পৃথিবীর বুকে অনেক ভাললাগা তার মনকে ভরিয়ে তোলে। বেড়াতে গিয়ে তারা হোটেলে ওঠে।
মেয়েরা সবাই এক ঘরে আর ছেলেরা অন্য ঘরে। অনামিকা মাঝে মাঝে বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসার পর ছেলেদের ঘরে গিয়ে গল্পও করত, সময় কাটাত। যেহেতু সে বয়সে অনেক ছোট আর বাবা নেই তাই সবারই মনে একটু বেশীই জায়গা ছিল অনামিকার। সবাই তাকে স্নেহ করত আর সেও সহজ সরল মনে মিশত সবার সাথে। অনিমেষের সাথে ছিল একটু বেশি ভালবাসা, আবদার, জেদ, রাগ অভিমান সব কিছু। কারণ অনিমেষের মধ্যে সে তার বাবাকে খুঁজে পেত মাঝে মাঝে। বাবার না থাকার কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পেরেওছিল অনেকটা। অনিমেষের মনের কোন এক কোনে এই ছোট্ট মেয়েটি একটু জায়গা করে নিতে পেরেছিল।
একটা ছোট্ট মেয়ে বয়ঃসন্ধিক্ষণ তার আবদার, ভালবাসা তার উচ্ছলতা কোথায় যেন অনিমেষের মনকে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তা কোন দিন বুঝতে দেয় নি অনামিকাকে। একদিন বেড়িয়ে এসে সে ছেলেদের ঘরে গেছে যেমন সে অন্য দিন গুলোয় যায় অনিমেষ গান গাইছিল শুনে মুগ্ধ হয় -তার মনে হয় ঠিক এমনটাই যেন গাইত তার বাবা।পরদিন এক নতুন পাহাড় দেখতে যাবার কথা। সারা পথ অনামিকার মনে সেই গানটার সুর ভাসতে থাকে। চারিদিকের সৌন্দর্য, পাহাড়ের ঠাণ্ডা বাতাস পায়ের নীচের জমিতে কি সুন্দর ছোট ছোট ফুল বিছিয়ে আছে যেন কার্পেট পাতা রয়েছে, ঝর্নার প্রবল ধারা সেই কোথা থেকে নামছে গর্জন হালকা ছাট আসছে মুখ ভিজে যাচ্ছে, কি অপরূপ দৃশ্য। মনের সব গ্লানি, দুঃখ এক নিমেষে কোথায় উধাও। প্রকৃতির কি অসীম সৃষ্টি, সারা দিন রাত ধরে ঝর্ণা বেয়ে নামছে আর পাহাড়ের নির্জনতা কেউ কোথাও নেই চারিদিক শূন্যতা, সেই শূন্যতার যে অসীম ক্ষমতা- নীরবতার ভাষা অপার। সন্ধ্যাবেলা যখন একরাশ অন্ধকার এসে জমা হয়েছে ঠাণ্ডায় হিম হয়ে যাচ্ছে শরীর, তখন সবাই আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বসে গল্প করছে আর কেঊ কেউ একটু পানে ব্যাস্ত তখন অনামিকা তার গায়ের সোয়েটার আনতে যায় ওপরের ঘরে। অনিমেষ ও যায় কারণ সব সময় সে পাশে থাকছে অনামিকার। অনিমেষ বলে নিয়েছিস সোয়েটার?
অনামিকা তাড়াহুড়োয় নিতে গিয়ে টেবিলের কোনায় লেগে পায়ে ব্যথা পায়। অনিমেষ তাকে বসিয়ে পা- টা দেখে ওষুধ লাগায়। কী জানি কি ভালোলাগায় জড়িয়ে ধরে অনিমেষকে। যেমন কোরে সে তার বাবাকে ধরত। কিন্তু এই স্পর্শ যেন আলাদা মনে হল অনামিকার। বয়ঃসন্ধিক্ষণের অনুভূতি যেন তার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। মনে মনে ভাবছে একি- এ অনুভূতি যেন অন্যরকম কিন্তু অদ্ভুত আবেশ দুজন দুজনকে জড়িয়ে রইলো। তার পর আলতো করে একটি উষ্ণ ছোঁয়া। অনিমেষের ওষ্ঠ অনামিকার ললাট স্পর্শ করলো। দুজনের শরীরে খেলে যাছে এক বন্য ভালোবাসা। আবেশে বিভোর হয়ে মেতে ঊঠেছে তাদের শরীর ও মন। ভুলে গেছে সমাজ পরিবেশ। এই অনুভূতি যেন কোনদিন তারা পায় নি। উন্মাদনার আবেশ হঠাৎই কেটে গেলো। দরজায় কড়া নাড়ল কে, কে যেন বললো অনামিকা আয় সবাই অপেক্ষা করছে নীচে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় তার পর নীচে আসে দুজন। আগুনের পাশে বসে অনামিকা দূরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ। দুজনের মনের মধ্যে ঝড় চলছে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না কারণ সমাজ যে এই অসম সম্পর্ক মেনে নেবে না কোনোদিন।