“চাওয়া পাওয়া”
কলমেঃ সোহিনী ঘোষ।
বৃদ্ধাশ্রমের জানালায় বসে রমেন ভাবতে থাকে সেই হারানো দিনের কথা। প্রায়ই মনে পড়ে সব অতীত দিনগুলোর কথা।
ছোটবেলা – বাবা – মা – বিয়ে – সংসার – কত ভালোলাগা মন্দলাগা সব সব মনে পড়ে। রাস্তার ধারের জানালাটা তার একমাত্র সঙ্গী। আরও যারা আশ্রমে থাকেন তারাও সবাই শুধুমাত্র বেঁচে আছেন। কবে ডাক আসবে ওপরওয়ালার তার অপেক্ষা।
দিন গোনা ছাড়া আর যেন কোনো কাজই নেই। সকাল থেকে রাত কেবলই অপেক্ষা। অপেক্ষা করত প্রথমদিকে আজ হয়তো ছেলে/মেয়ে আসবে। নাতি/নাতনি দাদু বলে ডাকবে, জড়িয়ে ধরবে। নাহ তা আর হবার নয়।
প্রথমদিকে ছেলে আসতো মাঝে মধ্যে। আজকাল আর আসেই না। বড্ড কাজের চাপ। সংসার -ছেলে – মেয়ে সামলে বৃদ্ধ বাবার জন্য আর সময় বের করতে পারে না রক্তিম। স্বামী-স্ত্রীর নামের মিল খুঁজে নাম রেখেছিল। রমেন – করবী।
কত আশা – কত স্বপ্ন – কত ভালোলাগা – কত ত্যাগ – সব দিয়ে সন্তানকে বড় করেছিল রমেন-করবী। ঠাকুরদা ঠাকুরমা সবার ভালোবাসাই রক্তিম পেয়েছে। কিন্তু তাও তাও কি করে সবটা ভুলে যেতে পারলো রক্তিম?
বা-মা তো তাকে সু-শিক্ষা দিয়েই বড় করেছে। তবু তবু কেন? তাহলে কি পারেনি রমেন তার সন্তানকে সু-শিক্ষা দিতে।
রমেনের মনে হয় সেই ছোটবেলাটা যখন রক্তিম এসে জড়িয়ে ধরতো তার বাবাকে। অপেক্ষা করতো কখন বাবা আসবে। বাবা ছেলেতে কত খুনসুটি।
মতের মিল না হলে দাদুকে নালিশ। কোথায় গেল সেই সব দিন? ফিরে আর আসবে না। যে দিন চলে যায় আর তা ফিরে আসে না।
রমেনও দাদু হয়েছে। তারও মনে হয় নাতি নাতনিকে নিয়ে খুব সুন্দর সুখী জীবন কাটাতে। কতই বা খরচ হতো তার জন্যে। ঘরের এক কোণে কি জায়গা হতো না?
ছেলে বৌমার দাম্পত্য জীবনকে কি খুব অতিষ্ঠ করে তুলেছিল? কত ভাবনা মাথায় ঘোরে। খুব ইচ্ছে হয় অতীতে ফিরে যেতে। অতীতটা যদি বর্তমান আর বর্তমানটা যদি ভবিষ্যৎ হতে পারত।
না তা হবার নয়। ছেলে বৌমা সবার কাছেই সে আজ বড্ড বোঝা। জায়গা জুড়ে থাকে আবর্জনা স্বরূপ। অথচ এই বাবাই একদিন সব স্বপ্ন পূরণ করার জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে রক্তিমকে বড় করেছে। নিজের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে। সন্তানকে দুধে ভাতে রাখার জন্য। আর সন্তান রোজগার করবে গর্বে ভরে যাবে বাবার বুক। রক্তিম বলতো বাবা বড় হই দেখবে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেব। আর রোজগার করতে দেবই না। শুধু শান্তি করে জীবন কাটাবে নিশ্চিন্তে।
হ্যাঁ একপ্রকার শান্তি বা নিশ্চিন্তেই জীবন কাটাচ্ছে রমেন বৃদ্ধাশ্রমের কোনো এক কোণের ঘরে। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ে। নতুন একটা দিন আবার নতুন করে অপেক্ষা। এ অপেক্ষা সন্তানকে দেখবার, একটিবার তাকে স্পর্শ করার।
সন্তানকে দু-হাতে আগলে বড় করেছে তার কান্নায় বাবাও কেঁদেছে। আজ কি একবারও মনে পড়ে না রক্তিমের সে সব দিন? কোথাও কি মিল পায় না তার সন্তানদের সাথে?
সন্ধ্যা নেমে আসে, নেমে আসে একরাশ অন্ধকার আর সাথে নিরাশা আর হতাশা। আজও এলো না। এমন কোনো সময় নেই যখন মনে পড়ে না সন্তানের কথা। কত কত স্মৃতি – আজ অবসরপ্রাপ্ত – কাজ নেই। কাজ একটাই স্মৃতি রোমন্থন।
কোনো সময় ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা কোনো সময় বা চোখের কোণ ভিজে আসে। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। বেঁচে থাকা কেবলই মন হীন দেহ। শরীরটাকে কেবলই বয়ে নিয়ে চলা।
ভাবতে ভাবতে কখন চোখ বুজে আসে আবার নতুন সকাল। জানালা দিয়ে অপেক্ষারত রমেন হঠাৎই যেন কাকে দেখতে পাচ্ছে? একি স্বপ্ন? চোখ কচলে আবার দেখছে – নেই। সত্যিই স্বপ্ন দেখছে রমেন।
কার ডাক – কে ডাকছে? কে? রক্তিম? না – না কি করে হয়? হ্যাঁ রক্তিম। হঠাৎই বাঁধ মানছে না। ছেলে আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রতিক্ষণ যার জন্য অপেক্ষা করে। সেই ছেলে আজ তার সামনে। কথা বের হয় না রমেনের মুখ থেকে।
ছেলে জড়িয়ে ধরেছে। বাবা যেন বোবা হয়ে গেছে। গলার কাছে কি যেন দলা হওয়া জমাট বাঁধা কষ্ট। রক্তিম ডাকছে বাবা – বাবা। চোখের জলের ধারা বাঁধ মানছে না।
শক্ত করে বাবাকে ধরে চোখের সামনে আনে। বাবা যেন কেমন একটা – বিছানায় শুইয়ে দেয়। সাথে সাথে ডাক্তারকে ডাকা হয়। বাবার তখন কেমন অবস্থা কেবলই চোখে জল অসাড় দেহ।
বড্ড দেরি করে এলি বাবা। কোনোরকমে বলল রমেন তার ছেলেকে। নার্সিংহোমের বেডে নাতি নাতনি সবার সাথে দেখা হল। কিন্তু আদর আর ভালোবাসাটা এ জন্মে আর পাওয়া হল না।
চোখের জলে আর স্নিগ্ধ চাওয়ায় দৃষ্টি যেন ক্ষীণ। হারিয়ে যেতে হল রমেনকে।