রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও এবং চুয়াডাঙ্গা থেকে বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারী ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। এসময় পৃথক নারী পাচারচক্রের প্রধান অভিযুক্তসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব বলছে, কামরুল ইসলাম ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে রাজধানীতে এসে চালাতেন রিকশা। ২০১৬ সালে এফডিসি ও বিভিন্ন শুটিংস্পটে আসা-যাওয়া শুরু তার। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন কথিত ‘ড্যান্স ক্লাব’।
এই চক্রে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার অপরাধে জড়িত। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা হতে কমবয়সী তরুণীদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে শতাধিক নারীকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে।
শনিবার দুপুরে র্যাব-৪ কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারচক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুন, রিপন মোল্লা, আসাদুজ্জামান সেলিম, নাইমুর রহমান। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারচক্রের বাকি সদস্যরা হলেন, নুর নবী ভুইয়া রানা, আবুল বাশার, আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহিদ শিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও টোকন।
অভিযানে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল, বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, দুইটি মোটর সাইকেল উদ্ধার করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা জানতে পেরেছি পাশ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল। এই চক্রে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার অপরাধে জড়িত। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা হতে কমবয়সী তরুণীদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে।
র্যাব জানায়, প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ বা ড্যান্স শিখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসত। পরে তাদেরকে বেপোয়ারা জীবন যাপনে অভ্যস্ত করত। পরবর্তীতে তাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকুরীতে প্রলুব্ধ করে পাচার করত। এভাবে এই চক্রটি তিনবছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে।
র্যাব আরও জানায়, ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করত। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশে অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হতো। এই চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।
ভিকটিমদেরকে সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে জানিয়ে খন্দকার আল মঈন জানান, এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। এরপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহরে/প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিত। এরপর থেকে ভিকটিমদের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।
কামরুলের উত্থান
র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার মঈন বলেন, ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমায়। এরপর বাড্ডা এলাকায় রিক্সাচালক হিসেবে জীবিকা শুরু করে। কিছুদিন পর সে একটি কোম্পানীর ডেলিভারী ভ্যান চালক হিসেবে কাজ নেয়। এরপর ড্যান্স গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। এই ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করত। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পাশ্ববর্তী দেশে পাচার করত।
মধ্যপ্রাচ্যে পাচার চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী একটি চক্র। চক্রে দেশে ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ৫/৭ বছর যাবত এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে নারী ও পুরুষ মানব পাচার করে আসছে। হাউজকিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি পেশায় নারী কর্মীদের বিনা অর্থে প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সী তরুণী ও মধ্য বয়স্ক নারীদের প্রলুব্ধ করত চক্রটি। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেওয়া হত। এ পর্যন্ত চক্রটি ইতিমধ্যে ৩০-৩৫ জন নারী’কে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেফ হাউজ পরিচালনা করে। বেশকয়েকদিন সেফ হাউজে ভিকটিমদের আটকে রেখে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ভিকটিমদের একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকার বিনিময় বিক্রি করা হত। চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। চক্রটি কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে আসছে।
র্যাব জানায়, প্রথমত তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে উঠতি বয়সী এবং আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছল যুবক-যুবতী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের টার্গেট করে তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখায়। এতে তারা রাজী হলে প্রথমত তাদের ঢাকায় অবস্থিত সাজানো অফিসে এনে বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করে এবং বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বল্পকালীন ভূয়া প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করে। এ সময় কোন নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের কাছে দেড় হতে দুই লাখ টাকা দাবী করতো। এই মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা নুর-নবী ভুইয়া রানা।
এই চক্রের প্রধান নুর-নবী ভুইয়া রানা লক্ষীপুরের স্থানীয় একটি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে সে ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করে। ওমানে থাকা অবস্থায় মানব পাচারকারী একটি চক্রের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তখন থেকেই মানব পাচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে। ছবি: সংগৃহীত