কিছুদিন আগেই কিংবদন্তী গায়িকা ও ছোট বোন আশা ভোঁসলে (Asha Bhonsle)-কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। এবার ছিল তাঁর নিজের জন্মদিন। দেখতে দেখতে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জীবনের একানব্বইটি বছর পার করে ফেললেন জীবন্ত সরস্বতী লতা। তাঁর জন্মদিনে নতুন করে ভাইরাল হয়েছে 2018 সালের একটি ভিডিও যেখানে তাঁর চোখে অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, লতা ‘স্বর মূরলী’ অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিতে এসেছেন। পুরস্কার গ্রহণ করার পর তাঁকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছেন। এর মধ্যেই অনেকে তাঁকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়েছেন। বর্ষীয়ান গায়িকা মানুষের এই ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে উঠেছেন। তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠেছে। 28 শে সেপ্টেম্বর লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) টুইট করে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। লতা শুধুমাত্র ভারতবর্ষের নন, তিনি সমগ্র পৃথিবীর কাছে সঙ্গীতের প্রতিভূ। শৈশবে বাবার কাছেই লতার সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি। কিন্তু হঠাৎই পরিবারের উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। পিতৃহারা হলেন লতা। আশা, উষারা তখন অনেক ছোট। সবকিছু ছেড়ে সংসারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। প্রথমে মারাঠি ফিল্মে অভিনয় করতেন লতা। সেখান থেকেই গানের জগতে প্রবেশ।
একসময় গানের মাধ্যমেই পুরো সংসারকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। সংসার ও কেরিয়ারের তাগিদে বিয়ে করেননি তিনি। একসময় ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর মতো রিয়েলিটি শো নিয়ে তাঁর মত ছিল, এই ধরনের শো থেকে কেউ কখনও সফল গায়ক বা গায়িকা হতে পারেন না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সেই মত বদলেছে। 92 বছর বয়সে এসেও লতা মঙ্গেশকর সঙ্গীত তথা সমগ্র সংস্কৃতি জগতের কাছে গর্ব।
গোটা ভারতের সুর সম্রাজ্ঞী, যাঁকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভালোবেসে ‘ভারতের কোকিল’ বলেও সম্বোধন করা হয়, বাংলা গানের জগতে সেই লতা মঙ্গেশকরের অবদান মোটেও অকিঞ্চিৎকর নয়। আজো তাঁর কণ্ঠের বহু বাংলা গান হয়ে ওঠে আমাদের অবসরের সঙ্গী কিংবা সুখ-দুঃখের যাপন পাথেয়। স্বনামধন্য এই কণ্ঠশিল্পী এক হাজারের বেশি ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য গান গেয়েছেন। ৩৬-টি ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়ার পাশাপাশি বিদেশী ভাষাতেও গান রেকর্ড করেছেন। তিনিই দ্বিতীয় কণ্ঠশিল্পী যাঁকে ভারতীয় নাগরিকদের প্রদেয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত রত্ন’ দেওয়া হয়েছে। ১৯২৯-সালের ২৮-শে সেপ্টেম্বর, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে সংগীতজ্ঞ ও সুরকার দ্বীননাথ মঙ্গেশকর এবং তাঁর দ্বিতীয় পত্নী সেবন্তীর কন্যা লতার জন্ম হয়। জন্মের সময় অবশ্য তাঁর নাম রাখা হয়েছিল হেমা। পিতা দ্বীননাথ একদিকে যেমন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন, অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ নাট্যকার। তাঁর লেখা নাটক ‘ভাববন্ধন’-এর একটি চরিত্রের নামে, মেয়ের নাম পাল্টে তিনি রাখেন ‘লতা’। ১৯৪২-সালে, লতার বয়স যখন মাত্র ১৩, তখনই হৃদরোগে তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটে। বাবার বন্ধু এবং ‘নবযুগ চিত্রপট’ ফিল্ম কোম্পানির মালিক মাস্টার বিনায়ক লতাকে চলচ্চিত্রে গান গাইবার ও অভিনয় করার সুযোগ করে দেন। ১৯৪৫-সালে লতা মুম্বাই চলে আসেন। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন উস্তাদ আমন আলী খানের কাছে। জানলে অবাক হবেন যে প্রযোজক শশধর মুখার্জি কিশোরী লতার গলা খুবই সরু বলে তাঁকে ফিল্মের কাজে নেননি! ক্রমে লতা গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব গায়কী। উর্দু এবং হিন্দি উচ্চারণ শিখতেও নেন প্রশিক্ষণ। তাঁর প্রথম বিখ্যাত গান “আয়েগা আনেওয়ালা” তাঁকে এনে দেয় খ্যাতি। এরপরেই শুরু হয় একের পর এক মনহরা গান গেয়ে সুরের সম্রাজ্ঞী খেতাব জয়ের পালা! সলিল চৌধুরীর সুরে “আজা রে পরদেশী” গানটি গেয়ে লতা পান ফিল্মফেয়ার বেস্ট ফিমেল প্লেব্যাক পুরস্কার।
লতা যখন খ্যাতির সিঁড়ির ধাপ ভেঙে শীর্ষে উঠছেন, ১৯৬২-সালের গোড়ায় ধরা পড়ে যে তাঁকে স্লো-পয়জন করা হয়েছে। তিনমাস অসুস্থ ছিলেন লতা। তবে, থেমে যায়নি তাঁর জয়যাত্রা। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক অবধি চুটিয়ে গান গেয়েছেন, হয়ে উঠেছেন আট থেকে আশি সবার চোখের মণি। হিন্দি ও মারাঠির পাশাপাশি বাংলাতেও ১৮৫-টি গান গেয়েছেন লতা। বাংলা গানে তাঁর হাতেখড়ি হেমন্তের সুরে ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ গানটি দিয়ে। কাজহ করেছেন ভূপেন হাজারিকার সাথে, সলিল চৌধুরীর সুরেও গেয়েছেন বহু গান। লতাই প্রথম ভারতীয় সংগীতশিল্পী যিনি রয়্যাল আলবার্ট হলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গেয়েছেন।
লতা মঙ্গেশকর প্রথম গান গেয়েছিলেন মারাঠি ছবি ‘কিতি হাসাল’-এর (১৯৪২) জন্য। দুঃখজনক ঘটনা হলো, চূড়ান্ত সম্পাদনায় বাদ দেওয়া হয় ‘নাচু ইয়া গাদে, খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ কথার গানটি।
‘মজবুর’ (১৯৪৮) ছবিতে প্রথম বড় সুযোগ পান লতা মঙ্গেশকর। এ ছবিতে ‘দিল মেরা তোড়া’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন তিনি। তবে তার প্রথম তুমুল জনপ্রিয় গান হলো ‘মহল’ (১৯৪৯) ছবির ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। এতে অভিনয় করেন প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেত্রী মধুবালা।
পঞ্চাশের দশকে হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন লতা মঙ্গেশকর। তখন থেকেই তার ক্যারিয়ার ক্রমে উঁচুতে উঠেছে। তবে পঞ্চাশের দশকে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে দ্বৈরথের কারণে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাজ করেননি।
শচীন দেব বর্মণের পুত্র রাহুল দেব বর্মণের সুরে অনেক গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘পরিচয়’ (১৯৭২) ছবির ‘বীতি না বিতাই’। এর জন্য ১৯৭৩ সালে সেরা গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশি গানের শিল্পী হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পান লতা মঙ্গেশকর।
নব্বই দশকে এ আর রাহমান ও প্রয়াত গজল সম্রাট জগজিৎ সিংয়ের সঙ্গে কাজ করেছেন লতা মঙ্গেশকর। প্রয়াত যশ চোপড়ার প্রায় সব ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
গান গেয়ে সর্বোচ্চ খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করেছেন লতা মঙ্গেশকর। এর মধ্যে রয়েছে পদ্মভূষণ (১৯৬৯), দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৯), ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৩), পদ্মবিভূষণ (১৯৯৯), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ (২০০১)। সবশেষ ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি ‘ডটার অব দ্য ন্যাশন’ উপাধি লাভ করেন।
১৯৯০ সালে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়েন লতা মঙ্গেশকর। তার প্রযোজনায় গুলজার পরিচালনা করেন ‘লেকিন’ (১৯৯০) ছবিটি। এতে ‘ইয়ারা সিলি সিলি’ গানের জন্য তৃতীয়বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান লতা। এটি সুর করেন তার ছোট ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।
৯২ বছর বয়সেও তার জাদুকরী গায়কি নিয়ে সঙ্গীতজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই ভাস্বর লতা মঙ্গেশকর।