কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জীঃ চলে গেলেন ভারতীয় ফুটবলের ত্রিমূর্তি ব্রহ্মা-বিষ্ণু- মহেশ্বরের অন্যতম প্রবাদ প্রতিম ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম।
চূনী- পিকে দূরের নক্ষত্র অনেক দূর থেকে তাঁদের ঔজ্জ্বল্য দেখেছি। কিন্তুু বলরামদা ছিলেন কাছের মানুষ,হৃদয়ের আপনজন।তাই তাঁর বিয়োগ ব্যাথায় মনটা আজ খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।
কত ঘটনা মনে পড়ছে, কত স্মৃতি!! আমার জীবনের তা পরম সঞ্চয়। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি ভেবে পাচ্ছিনা।
প্রথম সাক্ষৎটা খুব একটা সুখকর ছিলনা। তাঁকে ভারতীয় ফুটবল বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলাম শুনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন ফুটবল বিষয়ে আমার সঙ্গে কিছু বলবেননা। পরে জানতে পেরেছি তাঁর অন্তরের বেদনা।
প্রতি শনিবার উত্তরপাড়া বাজারে দেখা হত। গুড মর্নিং বলরামদা। উত্তরে বলতেন,ভেরী গুড মর্নিং ভেরী গুড মর্নিং।
পরে দেখা হলে কখনো বলতেন গুড মর্নিং স্যার কখনো গুড মর্নিং দাদা।
একবার বললাম, শনিবার বাজারে এলেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়।
উত্তরে বললেন, আমার রোজ বাজারে আসার দরকার হয়না। তবু কেন আসি জানেন, এই আপনাদের মত মানুষদের সঙ্গে দেখা হবে বলে।
আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।
ভাবতে পারছিনা কোন বলরামকে বড় করে দেখবো মানুষ বলরাম না ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম। পিঠে হাত রেখে বলতাম আপনার মত মানুষকে ছোঁয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সঙ্গে সঙ্গে জিব কেটে বলতেন এইরকম বলবেননা। আপনারা আছেন বলেই আজ আমি তলসীদাস বলরাম হতে পেরেছি। বাজার করার পর দুজনে হাঁটতে হাঁটতে জিটি রোড ধরে যেতাম। উনি স্টেট ব্যাঙ্কের পাশ দিয়ে গঙ্গার ধারে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যেতেন,আমি গণভবনের সামনে থেকে রিক্সায় উঠতাম।
একবার বলরামদাকে বললাম গতকাল রেডিওর এক অনুষ্ঠানে আপনার বিষয়ে শুনলাম। তিনি বললেন কোন ব্যাপারে বলুনতো?
আমি বললাম বাংলা – মহারাষ্ট্র সন্তোষ ট্রফির ফাইনাল ম্যাচ আপনি ইনজিওর্ড হয়েছিলেন। খেলার সম্ভাবনা ছিলনা।
বলরামদা বললেন তাহলে শুনুন।
‘ আমি এমন আহত হয়েছি যে ফাইনাল খেলা আমার সম্ভব নয়। আমাদের কোচ বলাইদাস চ্যাটার্জী আমাকে সুস্থ করে খেলাবেন বলে জেদ ধরেছেন।
রাত্রিবেলা আমার আহত পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ইস্তিরি গরম করে সেঁক দিতে লাগলেন।
আমি যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বললাম আমায় ছেড়ে দিন। আমার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়।
তখন রহিম সাহেব মহারাষ্ট্রের কোচ।কাছেই আছেন। বলাইদা তাঁকে ডেকে পাঠালেন।
তিনি এসে আমার অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। সমস্ত ব্যান্ডেজ খুলে রাতভর নিজের মত করে চিকিৎসা করলেন। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি জানতে পারিনি তিনি কখন চলে গেছেন।
পরদিন সাকালে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে দেখি রহিম সাব রাস্তার উল্টো দিকে দোকানে বসে চা খাচ্ছেন। আমি ওঁকে সেলাম জানালাম। উনি আমাকে ইশারা করে বললেন হাঁটো। তরপর বললেন জোরে জোরে হাঁটো। এবার বললেন আস্তে আস্তে জগিং করো, তারপর বললেন জোরে জোরে করো।
এইভাবে আমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলাম। পরদিন ফাইনাল ম্যাচ। বাংলা ৩-০ গোলে জিতল। তারমধ্যে দুগোল বলরামের।
১৯৬২ জাকার্তা এশিয়ান গেমস্। যেখান থেকে ফুটবলে শেষ সোনার পদক এসেছিল।
রহিম সাহেব কোচ। প্রথম দিকে তিনি পিকেকে দলে নিচ্ছিলেননা। পিকে প্রায় কান্নাকাটি করে বলরামকে ধরলেন যদি রহিম সাবকে বলে চান্স পাওয়া যায়।
আমি একটু ইতস্তত করে কোনরকমে সাহস সঞ্চয় করে রহিম সাবের ঘরে ঢুকলাম।
আমাকে দেখে রহিম সাব বললেন কি ব্যাপার ?
আমি বললাম, কাল তো খেলা আছে।
উনি বললেন, সেতো সবাই জানে। তুমি জানোনা ?
আমি বললাম পিকেকে যদি একটু চান্স দেন।
আমার কথা শেষ হবার আগেই রহিম সাব বললেন, তুমি কি জানো প্রথম এগারোয় তোমার নাম থাকবে কিনা। তুমি অন্যের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ। গেট আউট!!
এইরকম অসংখ্যা কাহিনী বলরামদার মুখ থেকে শুনেছি।
তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। বুকভরা অভিমান জমেছিল। সরাসরি কিছু বলতেননা আকারে ইঙ্গিতে বোঝা যেত।
হায়দরাবাদ থেকে যেসব মণিমানিক্যর মত ফুটবলার বাংলার ফুটবলকে উজ্জ্বল করেছিল বলরামদা তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে উজ্জ্বলতম।
আজ তিনি সমস্ত সুখদু:খ মানঅভিমানের ঊর্ধে চলে গেলেন।
এই মহান ফুটবলার তৎসহ মহান মানুষটি যেখানে গেলেন সেখানে শান্তিতে থাকুন আনন্দে থাকুন। তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ প্রনাম নিবেদন করি।
( চঞ্চল ব্যানার্জী ) সংগৃহীত