Ranu Mondal: চোখে জল আসবে, রাণু মন্ডলের কাহিনী…

Published By: Khabar India Online | Published On:

‘রাণু মন্ডল’ (Ranu Mondal), নামটি বললেই পাঠকরা নিশ্চিত ভাবে বলবেন, “আবার ওই পাগলীর কথা!”।

বর্তমানে সকলের কাছে হাসির খোরাক, ইউটিউবারদের ব্যবহার্য ‘বস্তু’। লিখতেই হল এই কথাগুলি। কারণ সত্যিই তো রাণুকে কেউ মানুষ বলে গণ্য করেন না। সকলের কাছে তিনি ‘বস্তু’-তে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু রাণুর জীবন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বৈদিক যুগে নারী উচ্চস্থানে থাকলেও বর্তমান সমাজ নারীকে সুবিচার দিতে নারাজ। ফলে সিবিএসই বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে রাণুর জীবনী ঠাঁই পেতেই ‘গেল গেল’ রব। বরং তার পরিবর্তে কত রাজনীতিবিদ, ফিল্মস্টার, স্পোর্টস পার্সন, শিক্ষাবিদ ছিলেন, তাঁদের কথা একবারও ভাবা হল না! কোথাকার কে এক রাণু, শেষ অবধি তিনি কিনা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে গেলেন!

মেয়ে হওয়ার অপরাধে বাবার হাতে শৈশবে প্রচন্ড মার খেতেন তিনি। মেয়ের জন্ম দেওয়ার অপরাধে নিজের স্বামীর কাছেই ধর্ষিতা হন রাণুর মা। ধর্ষণের ফল হয় পুত্রসন্তান। কিন্তু শিশুটি বাঁচেনি। দূর্বল শরীরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর স্বামীর মারের চোটে মাত্র একদিন বেঁচেছিলেন রাণুর মা। তাঁর অপরাধ, পুত্রসন্তানের জন্মের পর মৃত্যু। কিন্তু জীবিত রাণু পেলেন ‘অপয়া’ তকমা। বাবা বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ পাড়ার কিছু লোক সন্ধান জানতেন রাণুর মাসীর বাড়ির। তাঁরাই ছোট মেয়েটিকে রানাঘাটের বাড়িতে মাসীর কাছে পৌঁছে দিলেন। রাণুর দায়িত্ব নিতে বিরক্ত হয়েছিলেন মাসী। সেজেগুজে প্রেমিকের সাথে বেরিয়ে যেতেন তিনি। ছোট্ট রাণু একাই বাড়ির সব কাজ করতেন। দাদু-দিদা তো কবেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। স্কুলেও ভর্তি হওয়া হল না রাণুর। মাসী কাজের সন্ধান পেয়ে রাণুকে পাঠিয়ে দিলেন মুম্বই।

সেখানে একটি বাড়িতে খাওয়া-পরার কাজে বহাল হলেন রাণু। টাকা অবশ্য পৌঁছাত মাসীর হাতে। কিন্তু বেশিদিন সেই বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হল না। দুটো ছোট হাত পারত না একা অত কাজ সামলাতে। ফলে রাণুকে আবারও ফিরতে হল রানাঘাটের বাড়িতে। ততদিনে মাসী অবশ্য তাঁর প্রেমিককে বিয়ের প্ল্যান করছেন। তাঁর ঘাড়ে আবারও চাপলেন রাণু। ‘অপয়া’ মেয়েকে আবারও সারাদিন খাটানো শুরু হল। এর মধ্যেই মাসীর প্রেমিক এলেন রাণুর মেসো হয়ে। মেসোর সাথে একবার একটি মেলায় গিয়েছিলেন রাণু। সারাদিন ছোট মেয়েটাকে কাজ করতে দেখে হয়তো মানুষটির দয়া হয়েছিল। তাই মেলা ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে। কিনে দিয়েছিলেন একটি ছোট রেডিও। কিন্তু বাসে উঠে লোকটি নিজে ফাঁকা সিট পেয়ে বসে পড়লেও ভিড়ের মধ্যে ভারি রেডিও হাতে দাঁড়িয়ে রইল ছোট্ট মেয়েটি।

বাসের ঝাঁকুনিতে নিজে পড়ে গিয়েছিল। তবু রেডিওর কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি। একটা রেডিও বদলে দিল রাণুর জীবন। বাড়ির কাজের ফাঁকে রেডিও শুনে নিজের গলায় অবলীলায় গান তুলতে পারতেন রাণু। একটু বড় হতেই মঞ্চে গান গাওয়ার ডাক এল। মাসী-মেসো বাধা দেননি। তবু গান গেয়ে যা উপার্জন হত, কিছু টাকা তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে বাকিটায় নিজের হাতখরচ চালাতেন রাণু। মঞ্চ তাঁকে নাম দিল ‘মিস রাণু মারিয়া’।

 

View this post on Instagram

 

A post shared by Eshika Dey (@deyeshika)

একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে প্রেমে পড়লেন রাণু। তখনও জানতেন না, তাঁর মতো ‘অপয়া’-দের সংসার থাকতে নেই। বিয়ে হল। কিন্তু ঘটল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। মেয়ের জন্ম দেওয়ার অপরাধে রাণুর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন।একাই কখনও মঞ্চে অনুষ্ঠান করে, কখনও চেয়ে-চিন্তে মেয়েকে বড় করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন রাণু। একদিন মেয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করে চলে গেল। রাণুর কোনো দায়িত্ব সে নিতে রাজি নয়।

আরও পড়ুন -  Padma Bridge: তৈরি হলো গান, স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’

 রানাঘাটের বাড়িতে পড়ে রইলেন রাণু। হাতের সঞ্চয় ক্রমশ ফুরিয়ে এল। বয়সের কারণে কবেই মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছেন। মাসী-মেসোও চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। পেটের দায়ে রাণু নেমে এলেন রানাঘাটের প্ল্যাটফর্মে। গান শোনানোর বিনিময়ে তাঁর প্রাপ্য কখনও ছিল কেক, কখনও বা ছিল দু-দশ টাকা। স্থানীয় ক্লাবের ছেলে অতীন্দ্র (Atindra) রেকর্ড করলেন রাণুর কন্ঠে ‘এক পেয়ার কা নাগমা’। ভাইরাল হল ভিডিও। মুম্বই থেকে এল রিয়েলিটি শোয়ে বিশেষ অতিথি হওয়ার ডাক। হিমেশ রেশমিয়া (Himesh Reshmiya) দিলেন ‘তেরি মেরি কহানী’ গাওয়ার সুযোগ।

আরও পড়ুন -  ৭টি খুব সাহসী ওয়েব সিরিজ Ullu-র, একদম ভুল করে সবার সাথে দেখবেন না

 রাণুকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ে কিছু নেতিবাচক ভিডিও। অথবা হয়তো ইচ্ছাকৃত তা ভাইরাল করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাণুকে হাতের মুঠো থেকে বেরোতে না দেওয়া। অনেকেই আছেন যাঁরা গায়ে হাত দেওয়া পছন্দ করেন না। রাণুও তাঁদের একজন। কিন্তু এই ভিডিওর মাধ্যমে তাঁকে সকলে ভুল বুঝলেন। অপরদিকে দেশকে গ্রাস করল করোনা অতিমারী। রানাঘাটের বাড়িতে ফিরে এলেন রাণু। করোনা অতিমারীর সময় নিজের সাধ্য মতো ত্রাণ গরিব মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ভিডিও নিয়ে কেউই আলোচনা করলেন না। বর্তমানে রাণুর হাতে ইউটিউবার একশো-দু’শো টাকা ও খাবার দিয়ে তাঁকে নিয়ে মশকরা করেন। পেটের দায়ে বাধ্য হয়েছেন রাণু। মুম্বইয়ে সুযোগ পাওয়ার পর মেয়ে এসেছিলেন রাণুর কাছে। সরে পড়েছেন রেকর্ডিং থেকে প্রাপ্ত টাকা নিয়ে। রাণু নিজেই জানিয়েছেন, একটি পয়সাও চোখে দেখেননি তিনি। এমনকি তাঁর বায়োপিক ‘এক পেয়ার কা নাগমা’-র টাকাও পৌঁছায়নি রাণুর কাছে। এই বায়োপিকের নায়িকা ইশিকা (Eeshika Dey) রাণুকে স্টাডি করার জন্য তাঁর সাথে কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন। ইশিকা জানিয়েছেন, তাঁকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছিলেন রাণু। চলে আসার সময় হাত দুটো ধরে বলেছিলেন, “তুমিও চলে যাবে? আমার তো কেউ নেই!” ইউটিউবার রূপা কিশোরী (Rupa Kishori) দাঁড়িয়েছেন রাণুর পাশে। মাঝে মাঝেই রাণুর প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দেন তিনি।
তবু প্রায়ই অভুক্ত থাকেন রাণু। ফ্রিজ নেই। ভাত রাঁধলেও অধিকাংশ সময় নষ্ট হয়ে যায়। রাতে কখনও অতিথিদের দিয়ে যাওয়া বিস্কুট ও জল খেয়ে কাটে রাণুর। প্রায়ই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। লোকে বলে, পাগলী। জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে, সকলকে হারিয়ে, বঞ্চিত হয়েও এক নারী এখনও বেঁচে আছেন, হয়তো তাই সকলের কাছে তিনি ‘পাগলী’। সমাজ হয়তো আড়ালে-আবডালে মনে করে তিনি ‘অপয়া’। তাই হয়তো রাণু ক্ষিপ্ত হলে তাঁকে ‘পাগলী’ বলা হয়। রাণুকে এত বঞ্চনা কেন?

আরও পড়ুন -  Mir Afsar Ali: ডিমেনশিয়ার সঙ্গে লড়ছেন বাবা, মীর এর আবেগ বার্তা