সঙ্গীত ছিল তার চেতনায় ও মননে, সুধীন দাশগুপ্ত বাংলা মৌলিক গানের স্বর্ণযুগ বলে বিবেচিত হয়

Published By: Khabar India Online | Published On:

সুধীন দাশগুপ্ত একজন খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক। তিনি হিন্দি, অসমীয়া এবং ওড়িয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় কাজ করেছিলেন। তার রচনা ও পরিচালনায় বাংলা আধুনিক গানে স্পন্দনের সৃষ্টি করে। পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রের গানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন।
গীতিকার এবং সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত ১৯৩০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের যশোহর জেলার বড়কালিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মহেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। তার শৈশব কেটেছিল দার্জিলিং-এ। প্রধানত মায়ের প্রশ্রয়েই সুধীন্দ্রনাথের গানের জগতে পা রাখা। বাবা মহেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মোটেই এ সব পছন্দ করতেন না। দার্জিলিং গভর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তিনি। সেখানে থাকাকালীনই ক্যাপটেন ক্লিভার, জর্জি ব্যাংকস, রবার্ট কোরিয়ার কাছ থেকে শেখেন পিয়ানো। লন্ডনের রয়্যাল স্কুল অব মিউজিক থেকে মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করেন।

তখনকার দিনে ওয়েস্টার্ন মিউজিকে এমন ডিগ্রিধারীর সংখ্যা হাতেগোনা। যন্ত্রসঙ্গীতে অসামান্য প্রতিভাধর ছিলেন তিনি। সেতার, পিয়ানো তো ছিলই; বাঁশি, তবলা, এমনকী হার্পও ছিল সেই তালিকায়। সাধারণ হারমোনিয়মও যেন তার আঙুলের ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেত। স্বভাবত অন্তর্মুখী ও স্বল্পবাক মানুষ ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেনি কখনও কেউ। দার্জিলিংবাসী ধনী পিতার সন্তানটি শুধু যে ঘরে বসে বেহালা-পিয়ানো-ম্যান্ডোলিনে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন তা-ই নয়, র‍্যাকেট হাতে কোর্টও কাঁপাতেন তিনি।

তিনবারের রাজ্য ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন! কিন্তু ভাগ্যিস তরুণ সুধীন কর্ক রেখে হাতে ছড়া তুলে নিয়েছিলেন, নৈলে থৈ থৈ শাওন আর আসত কৈ? ছেলের সঙ্গীতে আগ্রহ দেখে পিতৃদেব পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের রয়াল মিউজিক স্কুলে। সেখান থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করে সুধীন মুম্বাই নয়, নলিন সরকার স্ট্রিটের এইচ এম ভির দপ্তরে এসে গেলেন, কমল দাশগুপ্তের সাকরেদি নিয়ে। ভাগ্যিস এসেছিলেন, নৈলে শেষ বিচারের আশায় বসেই থাকতে হত। দাশগুপ্ত শুধু পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের শিক্ষাই নয়। এনায়েত খানের কাছে সেতার শিক্ষা, রীতিমত ভাতখণ্ডে-চর্চা ভারতীয় মার্গ-সঙ্গীতে। দেশিবিদেশি লোকসঙ্গীতের অপার ভাণ্ডার তার হেফাজতে ছিল, ছিল কীর্তনাঙ্গ গানও, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘শ্যামও আজ বদলে গেছে’ (সন্ধ্যা) বা ‘ও শ্যাম যখন তখন’ (আরতি)-র মত গানে। এমনকি ছোটদের জন্যেও ‘হিংসুটে দৈত্য’ বা ‘ছোটদের রামায়ণ’-এ’ কী অসাধারণ সুর দিয়ে গেছেন সুধীনবাবু! ব্যাডমিন্টনে ছিলেন চাম্পিয়ান। ব্যাডমিন্টন খেলার পাশাপাশি শৈশবে তিনি শিখেছিলেন পিয়ানো, মাউথ অর্গ্যান, সেতার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। লণ্ডনের রয়াল কলেজ অব মিউজিক থেকে তিনি মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। আর সেঁতার শিখেছিলেন এনায়েৎ খাঁর রেকর্ড শুনে শুনে। ভাতখণ্ডেজির রাগসঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ অনুসরণে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের চর্চা করেছিলেন কিছুদিন। এছাড়া তার কাছে ছিল বাংলা লোকগানের বিশাল ভাণ্ডার। ১৯৫৩ সালে তার সুরারোপিত প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। শিল্পী ছিলেন বেচুদত্ত। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম চলচিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবির নাম ছিল ‘উল্কা’। সুররচনার পাশাপাশি তিনি গানও রচনা করেছেন।

আরও পড়ুন -  অনামিকা ‐ 2

১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশকগুলি বাংলা আধুনিক গানের পাশাপাশি বাংলা মৌলিক গানের স্বর্ণযুগ বলে বিবেচিত হয়। এই সময় গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, প্রণব রায়, রবিন চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র চিত্রোপাধ্যায়, অনোল চট্টোপাধ্যায়, অনুপম ঘটক, অনিল বাগচী, জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা এবং সুধীন দাশগুপ্ত প্রমূখ বিখ্যাত সংগীত পরিচালক এবং গীতিকারদের অবদানের মাধ্যমে বাংলা সংগীত সমৃদ্ধ হয়েছিল।

আরও পড়ুন -  তিন সন্তানকে বিষ খাইয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করল জন্মদাত্রী মা

সুধীন দাশগুপ্তকে পঞ্চাশের দশকের শেষেরদিকে গীতা দত্ত এবং গুরু দত্ত তাদের বোম্বের (মুম্বাই) প্রোডাকশন হাউসে যোগদান করবার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন। সুবীর সেন এবং সুধীন দাশগুপ্ত মুম্বাইয়ের তারদেও সোনাওয়ালা ভবনে একসাথে থাকেন। এ সময় সুধীনবাবু একটি গান রচনা করেছিলেন “এতো সুর আর এতো গান”, যা সুবীর সেন অনেক পরে রেকর্ড করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে সুবীর সেনের দ্বিতীয় রেকর্ডটিতে সুধীন দাশগুপ্তের দুটি রচনা “ঐ উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙ্গীন” এবং “স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে” মুক্তি পেয়েছিল। এই অমর সৃষ্টিগুলির সুরকার এবং গীতিকারক সুধীন দাশগুপ্তকে বিখ্যাত করে তুলেছিল এবং বাংলা গানের জগতে তার জন্য একটি স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছিল।

সুধীন দাশগুপ্ত অনেক গানের কথা লিখেছেন। তার গানের অগাধ জনপ্রিয়তা নিজেই তার গানের কাব্যিক মূল্যবোধগুলির সাথে তাদের সাহিত্যের মূল্যবোধের কথা বলে। তার সৃষ্টির প্রথমটি ছিল ১৯৫৪ সালে সুবীর সেনের জন্য। তিনি যে গানটি লিখেছিলেন, তা ছিল এত সুর আর এত গান। যা বাংলা সংগীত জগতের এক মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এত সুর আর এত গান যদি কোনদিন থেমে যায়

সেইদিন তুমিও তো ওগো জানি ভুলে যাবে যে আমায়।

কতদিন আর এ জীবন কত আর এ মধু লগন

তবুও তো পেয়েছি তোমায় জানি ভুলে যাবে যে আমায়।

আমি তো গেয়েছি সেই গান যে গানে দিয়েছিলে প্রাণ।

ক্ষতি নেই আজ কিছু আর ভুলেছি যত কিছু তার

এ জীবনে সবই যে হারায়, জানি ভুলে যাবে যে আমায়।
চলচ্চিত্ৰ তালিকা

বাঙালা ছবি উল্কা (১৯৫৭), ডাক হরকরা (১৯৫৮), গলি থেকে রাজপথ (১৯৫৯), হেডমাষ্টার (১৯৫৯), প্ৰবেশ নিষেধ (১৯৬০), যাত্ৰী (১৯৬০), পঙ্ক তিলক (১৯৬১), কান্না (১৯৬২), নিশিথে (১৯৬৩), তাহলে (১৯৬৪), দুই পৰ্ব (১৯৬৪), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), অন্তরাল (১৯৬৫), শঙ্খবেলা (১৯৬৬), আকাশ চোরা (১৯৬৭), অভিশপ্ত চম্বল (১৯৬৭), কখনো মেঘ (১৯৬৮), তিন ভুবনের পরে (১৯৬৯), প্ৰথম কদম ফুল (১৯৭০), মঞ্জরী অপেরা (১৯৭০), জয় বাংলা (১৯৭১), ছদ্মবেশী (১৯৭১), জীবন সৈকতে (১৯৭২), পিকনিক (১৯৭২), জবান (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২) ,রাতের রজনীগন্ধা (১৯৭২) ,সজারুর কাঁটা (১৯৭২) ,সোনার খাঁচা (১৯৭৩) ,বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩) ,নিশি কনা (১৯৭৩), এক যে ছিল বাঘ (১৯৭৩), এপার ওপার (১৯৭৩), জীবন রহস্য (১৯৭৩), প্ৰান্তরেখা (১৯৭৪), সঙ্গিনী (১৯৭৪), শৰ্মিলা (১৯৭৫), সেদিন দুজনে (১৯৭৫), পালঙ্ক (১৯৭৫), হংসবাজ (১৯৭৫) ,অপরাজিতা (১৯৭৬), কৰুণাময়ী (১৯৭৮), দৌড় (১৯৭৯), জব চাৰ্নকের বিবি (১৯৭৯) ,শুভ সংবাদ (১৯৭৯) ,পিপাসা (১৯৮২), অমর কুম্ভের সন্ধানে (১৯৮২), সুপৰ্ণা (১৯৮৩), বনশ্ৰী (১৯৮৩)।

আরও পড়ুন -  Good Mind: মন ভালো রাখতে যা করতে পারেন

আসামী ছবি অরণ্য (১৯৭১), কাজিরাঙার কাহিনী (১৯৮২)

পুরস্কার

তিনি ১৯৭২ সালে বাঙালা ছবি পিকনিকের জন্য শ্ৰেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নাৰ্লিষ্ট এসোসিয়েসন পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় একটি সংরক্ষণাগার তৈরি করে এই মহান সংগীতজ্ঞকে শ্রদ্ধা জানায়। যেখানে বাংলার তিন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের জীবন তার বৈচিত্ৰ্যময় সাঙ্গীতিক যাত্ৰা মৃত্যু আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

তিনি মঞ্জুশ্ৰী সেনগুপ্তকে বিয়ে করেছিলেন। তার পুত্ৰ সৌম্য একজন আৰ্কিটেক্ট ও কন্যা সবেরি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার।

১৯৮২ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করনে। প্রখ্যাত গীতিকার এবং সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের মৃত্যূবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।