কোটি কোটি সনাতন ধর্মাবলম্বী সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন করেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই উৎসব পালিত হলেও বাঙালীদের কাছে এটি দুর্গা পূজা নামে পরিচিত।
প্রতিবছর শরতের সময় এই পূজার আয়োজন করা হলেও তারিখে পার্থক্য দেখা যায়। হাজার বছর ধরেই এই রীতি চলে আসছে।
কী ভাবে নির্ধারিত হয় পূজার সময়, তারিখ ও ক্ষণ?
সনাতন ধর্মের শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রতি বছর শরৎকালে দুর্গাপূজা উদযাপন করা হয়। এই কারণে একে শারদীয় দুর্গোৎসবও বলা হয়ে থাকে।
চাঁদপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী স্থিরাত্মানন্দ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আমরা যেমন সাধারণ জীবনে সূর্যের হিসাবে দিনক্ষণ হিসাব করি, কিন্তু আমাদের ধর্মে সেটা করা হয় চন্দ্রের তিথি হিসাবে।”
“যেমন চাঁদ নিজের কক্ষপথে পুরো ঘুরতে সময় নেয় সাড়ে ২৯ দিন, তিনঘণ্টা কমবেশি আছে। কখন চাঁদ দেখা যাবে, সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবীর অবস্থান হিসাব করে তিথি নির্ধারণ করে নেয়া হয়।”
দুর্গাপূজার নিয়ম অনুযায়ী, আশ্বিন মাসে প্রথম যে অমাবস্যা হবে, সেটির নাম মহালয়া। এরপরে যে চাঁদ উঠবে, সেই চাঁদের ষষ্ঠ দিনে দেবীর বোধন বা মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু হবে।
যেমন, এ বছর মহালয়া হয়েছে ৬ই অক্টোবর বুধবার। সেই দিন থেকে গণনা করে পূজা শুরু হয়েছে ১১ই অক্টোবর থেকে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এই দিন পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে মাতৃপক্ষের শুরু হয়। দুর্গাপূজার আক্ষরিক সূচনা শুরু হল। এদিন থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গার আগমন কামনা করতে শুরু করেন। তাদের পুরাণ অনুযায়ী, মহাষষ্ঠীর দিনে দেবী পৃথিবীতে নেমে আসেন। মহালয়া শব্দের অর্থ মহান আলয় বা আশ্রম। হিন্দু ধর্মে বলা হয়ে থাকে, এদিন দেবী দুর্গার চক্ষুদান হয়েছিল। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর অমর হয়ে উঠেছিলেন। তবে সেই বরে বলা ছিল, শুধুমাত্র কোনও নারীশক্তির কাছে তার পরাজয় ঘটবে।
ফলে অসুরদের কারণে যখন দেবতারা অতিষ্ঠ, তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর মিলে দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। দেবতাদের দেয়া অস্ত্র দিয়ে তিনি অসুরকে বধ করেন।
যদি মহালয়া অন্য তারিখে হতো, তাহলে সেই হিসাবে দুর্গাপূজা শুরুর দিনক্ষণও পাল্টে যেতো। যেমন ২০১৯ সালের মহালয়া হয়েছিল ১০ই আশ্বিন বা ২৮শে সেপ্টেম্বর। সেই বছর দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল চৌঠা অক্টোবর।
একইভাবে ২০১৭ সালের মহালয়া হয়েছিল ১৯শে সেপ্টেম্বর, দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠী হয়েছিল ২৬শে সেপ্টেম্বর।
অর্থাৎ আশ্বিন মাসের অমাবস্যার ওপর নির্ভর করে মহালয়ার এই তারিখ অদলবদল হতে পারে।
প্রতি বছরেই কি আশ্বিন মাসেই পূজা হয়ে থাকে?
সূর্য ও চন্দ্র মাসের গণনার ওপর ভিত্তি করে হিন্দু ধর্মের দিনতারিখ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সনাতনী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সূর্যবর্ষ ৩৬৫ দিন এবং প্রায় ৬ ঘণ্টার পার্থক্য থাকে।
আবার চান্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনের । এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকে ১১ দিনের। তিন বছরে এটা এক মাসের সমান হয়ে যায়।
এই অতিরিক্ত পার্থক্য দূর করার জন্য প্রতি তিন বছরে একটি মাসকে অতিরিক্ত মাস হিসাবে গণ্য করা হয়, যাকে অধিক মাসও বলা হয়ে থাকে। সনাতনী ধর্মে একে বলা হয় মলমাস বা মলিন মাস বলা হয়।
স্বামী স্থিরাত্মানন্দ বলছেন, ”চাঁদের হিসাব এগিয়ে আসার কারণে ১০টা করে তিথি এগিয়ে আসতে থাকে। একসময়ে দেখা যাবে ১০টা তিথি কম পড়ে যাবে। আবার তিনবছরে ৩০টা তিথি কম পড়বে। তাই ওই ৩০টা তিথি যোগ করে সূর্য বর্ষের সঙ্গে সমান করা হয়। ওই মাসকে মলমাস বলা হয়।”
”এই কারণে দেখা যায়, পঞ্জিকা মতে আশ্বিন মাস ১০ দিন করে এগিয়ে এসে তিন বছরে ৩০ দিন এগিয়ে আবার আগের জায়গায় চলে আসে। ফলে ১০ দিন করে এগিয়ে এগিয়ে বৈশাখ মাসে যায় না, মলমাস বাদ দিয়ে আবার আশ্বিন মাসেই আসে।”
আশ্বিন মাসে পূজা ১০ দিন করে এগিয়ে আসতে থাকলেও আবার তিনবছর পর আগের জায়গায় ফিরে যায়।
সাধারণ হিসাবে, কোন মাসের ৩০ দিনের মধ্যে দুটি অমাবস্যা পড়লে তাকে মলমাস বলে গণ্য করা হয়। মলমাসে কোন পূজা পার্বণ করা হয় না। সেটাকে অতিরিক্ত মাস বলে গণ্য করা হয়। বছরের যেকোনো মাসই মলমাস হতে পারে।
২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই বছরের আশ্বিন মাস মলমাস হওয়ায় (আশ্বিন মাসে দুইটি অমাবস্যা হওয়ায়) পূজা পড়েছিল একমাস পরে কার্তিক মাসে। এর আগে ২০০১ সালেও এমনটা হয়েছিল। দেখা গেছে, প্রতি ১৯ বছর পরপর এটা ঘটে। আশ্বিন মাসেই কেন দুর্গাপূজা?
চাঁদপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী স্থিরাত্মানন্দ বলছেন, মন্ত্রের মধ্যে বলা আছে, যখন বর্ষাকাল শেষ হলে শস্য নতুন করে উৎপাদন হতে থাকে, সেই শস্যের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়। কারণ বলা হয়, জগতের মা যিনি পালন করছেন, তিনি শস্য রূপেই আমাদের জীবন রক্ষা করবেন। দুর্গা মানে যিনি দুর্গতিনাশ করেন। তিনি ক্ষুধারও দুর্গতিনাশ করেন।”
”এজন্য কৃষির সঙ্গে এটা সম্পর্কিত। এই কারণে বর্ষাকাল শেষে যখন নতুন করে আমার শস্য উৎপাদন হবে, এই সময়ে আবার পূজাটা কৃষকের জন্য – কৃষি, পৌরাণিক কাহিনী, দর্শন – এই সব কিছু মিলিয়েই এটা পূজার শুরু। আদিকাল থেকেই এই কারণে এই সময় এই পূজার শুরু হয়েছে। তিথিগুলোও সেভাবে ঠিক করা আছে যে, আশ্বিন মাসের এই সময় থেকে এই সময়ে পূজাটা হবে।” পঞ্জিকা অনুসারে ধর্মীয় রীতিনীতি
শুধু দুর্গাপূজাই নয়, সনাতন ধর্মের সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্রের অবস্থান, গতিপ্রকৃতি গণনা করে করা হয়।
কিন্তু সবার পক্ষে তো আর সেই গণনা করা সম্ভব নয়। এজন্য আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তৈরি হয় পঞ্জিকা। সেখানে সারা বছর ধরে সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্রের অবস্থান, গতি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে ধর্মীয় নানা রীতিনীতি পালনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সনাতন ধর্মের রীতিনীতিগুলো পালন করা হয় পঞ্জিকায় উল্লেখ করা তারিখ ও সময় অনুযায়ী।
চাঁদপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী স্থিরাত্মানন্দ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”দুই তিন বছর হাজার আগে থেকেই কাগজে বা কাঠে দাগ কেটে হিসাব করে নির্ধারণ করতো যে কখন চাঁদ উঠবে, কখন পূর্ণিমা বা অমাবস্যা হবে। সেখানে পৃথিবী, চন্দ্র বা সূর্যের কার কোন অবস্থান, সেটার কৌণিক অবস্থানও নির্ধারণ করা হতো। এরপর সেগুলো পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
হাজার হাজার বছর ধরে এসব রীতি চলে আসলেও আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সূর্য পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন সেই সময়ের জ্যোতির্বিদরা।
সেখানে সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের গতিপ্রকৃতি, অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করে বিভিন্ন পূজা-পার্বণের তারিখ ও ক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। বহুকাল ধরে সেই পঞ্জিকায় নির্ধারিত তারিখেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজাপার্বণ উদযাপন করতেন।
এখনো বেশিরভাগ স্থানে নবযুগ, লোকনাথ, গুপ্তপ্রেস ইত্যাদি নামে পরিচিত এসব পঞ্জিকা অনুসরণ করে পূজা উদযাপন করা হয়। পরবর্তীতে সেই পঞ্জিকায় কিছু সংশোধন আনা হয়। সেখানে সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান, গতি বিবেচনায় বিজ্ঞানের সহায়তা নেয়া হয়। একে বলা হয় দৃক পঞ্জিকা। পরবর্তীতে যে বিশুদ্ধ পঞ্জিকা তৈরি হয়েছে, এটাই মূলত দৃক পঞ্জিকার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।