“আঁস্তা”

Published By: Khabar India Online | Published On:

“আঁস্তা”

বেশ কয়েক দিন ধরেই অনির সাথে আমার কথোপকথন একটু বেশিই হচ্ছে।কথার মধ্যে শুধুই ঝামেলা ঝগড়া আর কথা কাটাকাটি। অনি মানে অনির্বাণ চ্যাটার্জি আমার অনেক দিনের বন্ধু।তবে বছর দুয়েক হোল বন্ধুত্ব টা একটু প্রমোশন পেয়ে ভালোবাসার স্তরে উন্নীত হয়েছে।।কিন্তু আজকাল যেন মনে হচ্ছে অনি আমাকে একটু এড়িয়ে চলছে।যে অনি আমাকে একদিন না দেখে থাকতে পারতো না সে আজ দিন পনেরো হল দেখাই করে না।আর ফোন করলে বলে খুব কাজের চাপ,নয়তো পরে করছি বলে ফোন কেটে দেয়।আমার মন ছটপটিয়ে ওঠে।এটা কি হচ্ছে?যে অনি আমাকে চোখে হারাতো সে আজকাল একবার একটু কথা বলারও সময় পায় না। ব্যাপার টা আমার কাছে ঠিকঠাক না লাগায় শনিবার ওর অফিসের গেটের কাছে চারটে থেকে দাঁড়িয়ে রইলাম ওকে ধরবো বলে।অনি চ্যাটার্ড ব্যাংকের উর্ধস্তন কর্মকর্তা।
ব্যাংকের গেটে আমাকে দেখে ও তোতলাতে থাকলো। কি ব্যাপার তুমি এখানে? এভাবে না বলে কেউ আসে এখানে?
কি করবো বল? তুমি দেখা করবে না।ফোন ধরবে না,তাই বাধ্য হয়ে মরিয়া হয়ে উঠে আমি আজ এখানে চলে এসেছি।বেশ কিছু দূর কথা বলতে বলতে আমরা হাঁটতে হাঁটতেএকটা কফি সপের কাছে এসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম ” অনি কফি খাবে”? অনি বলে উঠলো না না আমার কাজ আছে।আর তুমি এভাবে কখনও এসো না।শাড়ি পড়ে দু বেনী করে,এসব এখন আর চলে না।হট প্যান্ট টপ এসব পড়তে পারো না।
বললাম অনি অনেক দিনের অভ্যেস,তবু্ও তুমি যখন চাইছো বেশ চেষ্টা করবো পড়তে।আমার কথা শেষ হবার আগেই অনি’ কাজ আছে চলি ‘ বলে দ্রুত বেগে একটা ক্যাবে গিয়ে উঠলো।
আমি অপলক চাওনি তে ওর চলে যাওয়া দেখতে থাকলাম। আর মনে মনে ভাবলাম এই সেই অনি?
পুরনো অনেক কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি নিজেই জানি না। দেখি রনির ক্যাব টা বেড়িয়ে যাচ্ছে পাশে ববকাট চুল কালো হট প্যান্ট ও সাদা টপ পরিহিত একটা মেয়ে।আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে রাস্তা পার হচ্ছি আর পেছন থেকে একটা বাচ্ছা মেয়ের গলা ” ও দিদিমুনি ও দিদিমুনি থাম কেনে গাড়িটা তুকে ধাইক্কা মারবে”। এই অবধি কানে গিয়েছিল তারপর আর জানি না।
যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম বাচ্ছা মেয়েটা তার কোলে আমার মাথা টা নিয়ে এক গুচ্ছ রংবেরঙের ফুল দিয়ে জলের ঝাপটা দিচ্ছে।ঝাপসা চোখে ওর মলিন নোংরা কাপড়েও ওকে দেবদুত বলে মনে হচ্ছিল।কারণ মেয়েটি যদি আমাকে ঠেলে না দিত আমি গাড়ির ধাক্কা খেতাম,কি হোত তা ঈশ্বরই জানেন।
ঝাপসা ভাব টা আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠলাম বটে কিন্তু ওঠার ক্ষমতা নেই।মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?
মেয়েটি বললো ওর নাম “আঁস্তা”। মু থাকি হো–ই ফুডপাতে রে দিদি মুনি।বললাম তোর নাম আঁস্তা? সে আবার কি নাম? তোর বাবা মা কোথায়?
মেয়েটি বললো হুই আস্তাকুঁড়ে মুর জনম হইছিল তাইর লগে মুর নাম আঁস্তা বটেক।আর মুর বাপটো তো মুর জনমের আগুতেই মা টারে ছেইড়া চইল্যা গেল।উ আর আসে লাই।আর মা টা মুর লাগি খাইট্যা খাইট্যা পেরাণ পাইত কইর‍্যা মইর‍্যা গেল রে দিদিমুনি।আমি ইদিক উদিক থেইক্যা ফুল কুইড়া বেইচা দুইটা খাই।তু লিবি ফুল দিদিমুণি। তুকে পসা টো দিত্যে হইবেক লা।তুর মইন টা ঠিক হইবেক।
তারপর আঁস্তা আমাকে ধরে ধরে তুললো। আমি ওকে বললাম তুই আমার সাথে আমার বাড়ি যাবি? আমার কাছে আমার মেয়ে হয়ে থাকবি? ও একমুখ হাসিতে খুশি হয়ে সম্মতি জানালো।ওকে নিয়ে একটা ক্যাব ধরে বাড়ি ফিরলাম।।
সারারাত গায়ে জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর আঁস্তা সারারাত আমার মাথায় জলপটি দেওয়া,গা হাত পা টিপে দিয়ে জেগে রইলো।। ভোর বেলা আমার যখন ঘুম ভাঙলও দেখি ও মাটিতে ঘুমিয়ে গেছে।চা এনে ওকে ওঠালাম।চা বিস্কুট খেয়ে ওর মুখে যেন এক পরম সুখ ভেসে উঠলো।
সেই থেকে আঁস্তা কে আমি নিজের মেয়ের মতো রাখতে লাগলাম।ওর জামা কাপড়, পড়াশোনা, খাওয়া দাওয়া সব দিয়ে আজ আজ ও শুধুই আমার মেয়ে।এখন ও আমাদের মতো করেই কথা বলে।লেখা পড়াও ভালোই করে।আর আমাকে মা বলেই ডাকে,দিদিমুণি আর বলে না।
এ ভাবেই আমাদের বেশ ভালো দিন কাটছিলো।
বছর পাঁচেক পর সকাল বেলা পেপার পড়ছি,হঠাৎই দেখি বড় বড় করে অনির ছবি দিয়ে লেখা ব্যাংক থেকে কোটি টাকা তছরুপের দায়ে অনির্বাণ চ্যাটার্জির পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও জরিমানা দশ লক্ষ টাকা।খবরে আরও লেখা উনি এক একটা করে মেয়ে কে নিয়ে ভালো বাসার অছিলায় তাদের জীবন নষ্ট করেন৷ আর প্রচুর টাকা মদ খাওয়া দাওয়া বন্ধু বান্ধব মেয়েমানুষ নিয়ে ফূর্তি করেন।
খবর টা পড়ে আমি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লাম। আর ঈশ্বর কে ধন্যবাদ জানালাম আমাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য।।
আঁস্তা আমায় জিজ্ঞেস করলো ” কি হয়েছে মা”? ওকে কাগজ টা পড়তে দিলাম।তার আগে এই কবছরে ও সব জেনে গিয়েছে।আর পড়তেও শিখে গেছে।।ওর কোমল হাত দুটো আমার মাথায় রেখে বললো ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই করেন মা।তুমি আর চিন্তা কোরনা।।
আরও বছর পাঁচেক পর আঁস্তা মাধ্যমিক পাশ করেছে ৬৭৩ নম্বর নিয়ে। তাই আমি খুশি হয়ে
একদিন আঁস্তা কে নিয়ে একটু শপিং করতে বেরিয়েছি।রাস্তায় যেতে যেতে দেখি এক ভিখারি খাবার জন্য আমাদের কাছে কিছু পয়সা চাইছে।আঁস্তা বললো মা কিছু দিয়ে দাও।খাইনি বেচারা হয়তো। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।অনির এই দূর্দশা দেখে।কিন্তু আমার কোন মায়া হোল না।শুধু আঁস্তা কে বললাম ” চল এখান থেকে।কিচ্ছু দেব না।আজ তোর আর আমার এই একা থাকার জন্য এই লোকটা দায়ী।ওর পাপের ফল ওকে ভোগ করতে দে।।
জনান্তিকে বলে রাখি একটা কথা আমি অনেক খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলাম আঁস্তা র বাবা ওই লম্পট অনির্বাণ চ্যাটার্জি।।

আরও পড়ুন -  এই মাসেই শেষ ‘মিঠিঝোরা’! এল বড় সত্যি খবর
ডঃ শিপ্রা মুখোপাধ্যায় হালদার। লেখিকা।