মেঘলা মেঘলা সোনারঙ

Published By: Khabar India Online | Published On:

মেঘলা মেঘলা সোনারঙ

আগে তাও চারফুট বাই চারফুট ফোকর গলে একটুকরো আকাশ দেখা যেতো।এখন নির্মাণাধিন ইমারতের জন্য আর আকাশ তো দূরে থাক সকাল সন্ধ্যা আলাদা করতে পারা যায় না।
সব জানালা খুলে দিলে একটু দিনের আলো ভর করে বুঝি এখন দিন বা কখন রাত।সারাদিন ঘরে লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়।অথচ যখন এই বাড়িটায় গৃহপ্রবেশ হয় তখন তিন দিক খোলা বলেই গৃহীর গৃহপ্রবেশ হয়েছিলো।
এই লকডাউনের দিনগুলো তাই মন ভেসে বেড়ায় দেখা সেইসব দিনের ভাঁজে মাথা গুঁজে,যা ছিলো অনেক সমৃদ্ধ, অনেক বৈচিত্র্যময়।
অনেকবার পাহাড়ে গেছি।একবারের কথা খুব মনে পড়ে,ঝর্ণা খুঁজতে খুঁজতে এক পাহাড়ের ঢালবেয়ে লাঠি ভর করে নামছি সবাই,দূর থেকেই ঝর্ণার জলের ধারার শব্দ সকলকে মাতাল করে তুলছিলো,নামতে গিয়ে আমার ছয় মাস ও প্রায় দুই বছর বয়সী দুইটা দিগম্বর উপজাতি শিশুর প্রতি নজর গেলো,অবলিলায় খেলছে,মা ভেজা কাঠে,পাতা,লতায় উনুন ধরানো আপ্রাণ চেষ্টা করছে।আমরা একপাশে গিরিখাদ বর্ষার টিপটিপ বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাথর মাটির পথে চলতে চলতে ঘামে ভিজে জবজবে।ভয়ে আতংকে খুব সাবধানে পথ চলছি।অথচ কি অবলীলায় মা এই ক্ষুদ্র মানুষ্যশিশুদুটোকে এই খাদের ধারে পিচ্ছিল উঠোন পথে ছেড়ে নিজ কাজে ব্যতিব্যস্ত।প্রায়ই এই স্মৃতি আমার মগজের সিন্যাপসে ফিরে আসে।এখন মনে হচ্ছে, ওরা দিগন্তবিস্তৃত সবুজে অন্য এক স্বর্গে বাস করে।মুক্ত হাওয়া, মুক্ত প্রকৃতি,মক্ত প্রকৃতির শিক্ষায়।সে আরেক স্বাধীন জীবন,জুম চাষ,পরিশ্রম আর পাহাড়ি উচ্চতায় আকাশের মেঘের বদলে যাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে ভিন্ন জীবন বোধ।
এইতো সেদিন বসে ছিলাম সোনালী ধানের বিস্তৃত ক্ষেতের পাশে তাল বরই আর হিজল ছাওয়া গাঁয়ের এক কোণে।মানুষের আওয়াজ শুনে বিষদাঁতহীন ধোঁড়াসাপ নিরীহ প্রাণী ছুটে পালালো।
একজন তালের পুরুষ ফুলের মরা ডাল দেখে বলে উঠলো,সাপ নাকি? কি ওগুলো?
পাশেই হলুদ প্রজাপতিগুলো মুলোফুলে দুলে দুলে উড়ে উড়ে পরাগায়নের প্রাকৃতিক কাজে ব্যস্ত,আকাশের দিকে ফিরতেই তালের ডালে ডালে অসংখ্য বাবুই পাখির বেডরুম,ড্রয়িং রুমসহ রাতে জোঁনাই আলো জ্বলা ঘরগুলো দুলে উঠা চোখে পড়লো।
ভিন্ন ভিন্ন জীব আর জড় বস্তুর তান সুর লয়ে মাঝে মাঝেই গান হয়ে ওঠা জীবন দেখি এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যোগ অনুযোগে।
এই তো এবার পেরিয়ে যাওয়া শীতে,টঙ দোকানে বসে চিতই ভাপায় জিভ নাড়তে নাড়তে, যে কাঁচা রাস্তায় একদিন হাঁটুওব্দি শাড়ি তুলে,বর্ষা কাদায় মাখামাখি হয়ে, অন্যগৃহের জলকাদা সেচতে অনুপ্রবেশ করেছিলেম, সেই পথ এখন শানবাঁধানো রাজপথ।প্রায় অন্ধ এক আত্মীয়া,যার জন্মের ঠিক নেই বলে, পরিত্যক্তা সমাজ সম্পদে, ঝাপসা ঝাপসা দেখে জড়িয়ে ধরে মুখে হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করে আশীর্বাদের মালায় সিক্ত করে বলেছিলো,”অনেক অনেক ভালো থাকেন।অনেক ভালোবাসা।”যার সন্তান মায়ের চিকিৎসা করবে বলে,নিজ সংসার গড়েছে অন্য জায়গাতে। এই যে বৈচিত্র্য মানুষের সভ্যতাতে।
এসব খুব মিস করি।
কড়ই গাছের পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সবুজ সোনালী ভ্রমরগুলো।পাতা খেতো দিনে ও রাতে, সেই দিনগুলো খুব মিস করি।
এই বর্ষাতে পথের ধারে ব্যাঙ ডাকাটাও মিস করি।
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, ভেজা পাখিগুলোর কিচিরমিচির, ভোরে উঠে ডেঙগায় আঁচলপেতে চিংড়ি ধরে খুদের ভাতের সাথে ভর্তা খাওয়া, খুব মিস করি।
এই শহরে এই ঘরটাতে এক টুকরো আকাশে মেঘের কালো সাদা সূর্যের রশ্মিতে রঙিন হওয়া ক্ষনে ক্ষনে বদলে যাওয়া এখন খুব মিস করি।
থেকে থেকে ঠাকুরমার ঝুলি,দাদী নানীর বুলি, কাশবন গুলো,শাপলাশালুক,গানের জলসা,সুরের জ্বালা,কবিতার আসর,বইমেলা আর শৈশব, কৈশোর আর দুরন্ত সাহসী যৌবনের রাজপথ,মিছিল,মিটিং,বনের সবুজ,আকাশের নীল,বাবার শাসন খুব খুব খুব মিস করি সব।

আরও পড়ুন -  ভিভিপ্যাট ও ইভিএমের প্রদর্শন করা হয় নির্বাচনকে সামনে রেখে

জেবুননেসা হেলেন ( বাংলাদেশ )