খবরইন্ডিয়াঅনলাইন, রোজমেরী উইলসনঃ
রথের ভিড় উপচে পড়ছে রাস্তায়। প্রতিবারের মত রাহী এবার বেরোতে পারেনি এখনও ঘর থেকে, সকাল থেকে আকাশে মেঘেদের ভিড়, তার সাথে মাঝেসাঝে বৃষ্টি সারা দিন ধরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র রথবাহিনীকে সে কল্পনা করে চলেছে। রাহী ভালোবাসে বাচ্চাদের সাথে রথ টানতে, প্রতিবার রথের প্রসাদ, বাতাসা না খেলে তার মনে ভরেনা। কিন্তু এবার রাহীর স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট আর তারপর কলেজে কলেজে ভর্তির পরীক্ষা। তাই যতই দুচোখে সকাল থেকে বৃষ্টি ঝরুক, মা তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়নি। মায়ের এক কথা, রাহী বড় হয়েছে, এবার লাগামছাড়া জীবটায় রাশ টানতে হবে।
রাহী জানে মা যখন বারণ করে তখন কি করতে হয়। চুপচাপ সে ঠামের ঘরে চলে যায়।
‘কি দিদিভাই? মনটা ভালো নেই মনে হয়।’
রাহী চুপ করে থাকে। কি করে বোঝাবে ঠামকে সে রথ না সাজিয়ে দিলে পাড়ার আজিদ আর রথ বের করতে পারবে না। সোনাই, রেজাউর এরা সবাই অপেক্ষা করে থাকবে আজকের দিনটায় ভালোমন্দ রোল বা আলুর দম খাবে বলে। কিন্তু ঠামকে বলবে সে কি করে এসব কথা! ঠাম তো গোপাল সেবা করে তিন বেলা। যদি শুনে রাগ করে!
ঠামের ডাকে চমক ভাঙে রাহীর।
‘জানলার কাছে ঘুরঘুর করছে মেয়েটা কে গো দিদিভাই?’
রাহী ছোট্ট জবাব দেয়, -‘ ও সোনাই। ওপাড়ায় থাকে।’
‘দিদিভাই, আমি ওর নাম জানতে চাইনা। তোমার কাছে শুনতে চাই ও তোমার কে হয়?’
রাহী মুখ তুলে চায় ঠামের দিকে। এবারও কি তবে ধরা পড়ে গেছে সে? ঠাম কি করে সব জানতে পারে!’
ঠাম ঠিক বুঝতে পারে রাহী কি ভাবছে। ‘সেদিন ফেরার সময় রিক্সা নিয়েছিলাম দিদিভাই। যখন নামলাম নিজেই পরিচয় দিল, নাম বলল মইদুল, টাকা নেবে না। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, তুমি রোজ ফেরার সময় ওর বাচ্চাদের কাছে যাও রেললাইনের পাশের বস্তিতে। ওদের কি লাগবে না লাগবে জানতে চাও।’
রাহী চুপ করে থাকে। ঠাম জেনে গেছে ও কাদের সাথে মেশে। কিন্তু অদ্ভুত লাগে, ঠামের মুখে আদর মাখানো হাসি, তাতে প্রশ্রয় জড়ানো। ঠাম এবার মুখ খোলে।
‘দেশ ভাগের সময় যখন ওপার থেকে আসছি পাশের বাড়ির রেশমা আপু চিঁড়েমুড়ি বেঁধে দিয়েছিল সাথে। আমি তখন বুঝে পাচ্ছি না কোনটা নেব, আর কোনটা ছেড়ে আসব। একটা দেশ, যা আমার বুকে, তাকে কি করে ছেড়ে আসব দিদিভাই, মানুষগুলোকে কি করে ভুলব? ভালোবাসার কি রঙ হয় দিদিভাই? ভলোবাসার যদি কিছু ডাকনাম থাকে, তা হল ‘তবু মনে রেখ’ যেটা তুমি পেয়ে গেছ ওদের কাছ থেকে।’
সোনাই এবার একেবারে জানালার পাশটাতে এসে দাঁড়ায়। ঠাম সোনাইয়ের হাতে বাতাসার একটা প্যাকেট দিয়ে রাহীর দিকে তাকায়।
‘দিদিভাই, আর দাঁড়িয়ে থাকলে ওদের আর রথটাই হয়ত টানা হবে না’।
রাহী মায়ের কথা বলতে গেলে ঠাম পিছনে তাকাতে বলে ইশারায়। মা এগিয়ে এসে রাহীকে আদর করে। ‘এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যেতে নেই। জীবনে নম্বর পাওয়াটা দরকারি। তবে আমার পরীক্ষায় পাশফেলের ভয় আর নেই, তোমাকে মানুষ করার পরীক্ষায় আমি সফল হয়েছি’।
বাইরে তখনও বৃষ্টি থামেনি। রাহী বেরোনোর জন্য পা বাড়াতে গেলে মা ধমক লাগায়-
‘রাহী, তুমি এতটাও আর ছোট্টটি নেই যে ছাতা নিয়ে বেরোতে ভুলে যাবে। আর হ্যা, ঘুঘনি ও আলুরদম তোমার মা আর ঠাম খেতেও কিন্তু খুব ভালোবাসে।’