অনামিকা ‐ 2
সোহিনী ঘোষ।
অনামিকা আজ প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। সংসার তাকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে কষতে বসে অনামিকা ক্লান্তি অনুভব করলো। হিসেবের খাতায় মিল তো হয় না অমিলটাই বেশি নজরে আসছে। মন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
পর মুহূর্তেই মেয়ের ডাক শুনে আবার সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। যেন কোনো এক জগতে বিচরণ করছিলো। সব যেন মনের মধ্যে এসে ভীড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। কোনটা সরিয়ে কোনটা দেখবে।
মেয়েকে খেতে দিতে হবে, পা যেন চলতে চাইছে না মনে যেন পাথর চাপা পড়েছে। ভার সরিয়ে উঠতে যেন খানিক কষ্ট হচ্ছে অনামিকার। উঠে গিয়ে সংসারের নিয়ম মাফিক কাজ করে সে। কারণ সে তো ঘোরতর সংসারী। সংসার তার কাছে মন্দির। সারাদিন নিষ্ঠাভরে সে তার সর্বস্ব নিবেদন করেছে। তাই হিসেবের খাতায় তার ভুলটাই নজরে পড়ছে বেশি করে।
সেই কোন ছোটবেলায় অনিমেষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলো আজ তা অতীত। অনিমেষ কোথায় হারিয়ে গেছে কে তার খবর রাখে ? মনেই ছিল না তার গহীন কোনে কোথায় চাপা পরে গিয়েছিলো।
আজ হঠাৎ অবসরে কেন যেন কিসের তাগিদে অনিমেষকে বড্ডো মনে পড়ছে। যদি একটিবার তার দেখা পেত। অনামিকা দেখতো আজ সে কতটা বৃদ্ধ হয়েছে? আজও কি অনিমেষের মনে পরে অনামিকাকে? আদর করতে ইচ্ছে করে? কথা বলতে বলতে দু-দণ্ড শান্তিতে কোলে মাথা রাখতে, কত সব প্রশ্ন মনে ভিড় করেছে অনামিকার।
কিন্তু তার উত্তর মিলবে না কোনোদিনও। কারণ অনিমেষের খোঁজ পাবে কি করে। ভাবার অবস্থা তার নেই। কোন পরিচয়ে তাকে? লোকেদের কি বলবে? কে এই অনিমেষ? তার সাথে কি সম্পর্ক?
নানা ভাবনা আসে। ভাবনারা ভাবনাতেই থেকে যায়। আজ সে প্রৌঢ়। এই শেষ লগ্নে আজ হঠাৎই তাকে কেউ আবার নতুন করে ভালোবাসার কথা বলে। সেই কারণেই মনে পড়ে যায় অতীতকে। ঠিক এভাবেই ভালোবাসার কথা বলতো অনিমেষ।
একজীবনে প্রেম কি একবারই আসে? নাহ প্রেম তো বহুবার বহুভাবে আসতে পারে। প্রেমে পড়া কি খারাপ? পরকীয়া আজ ঘরে ঘরে।
নতুন করে প্রেমে পড়তে কে না চায়? হোক না তার প্রৌঢ়ত্ব। কি এসে যায়? মনে প্রাণে সে এখনো সদ্য যৌবনবতী। সংসারের চাপ সামলাতে সামলাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিলো তার মন।
আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখে সামনের চুলগুলোয় হালকা পাক ধরেছে। সিঁথিটাও চওড়া হয়েছে, গালের চামড়া কিছুটা কুঁচকে গেছে। মুখে সামান্য বলিরেখা দেখা দিয়েছে। তাতে কি সব কিছু সে ধীরে ধীরে চর্চা করে প্রাণবন্ত করে তুলবে নিজেকে। নিজেকে আবার রঙিন আলোয় মাতিয়ে দেবে। বেখেয়ালি মনটা আবার মাতাল হবে। চুলে রং করবে পার্লারে যাবে নিজেকে বদলে ফেলবে সে।
নতুন ভালোবাসা তাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে চাইছে তার মন। জীবনে আর কটা দিন এ বা বাকি আছে। চোখ বুজলে যে সে চোখ আর খুলবে তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে। তাই অনামিকা ঠিক করেছে এতদিন সে সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেছে। আর না এবার সে সংসারের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকেও পরিবর্তন করবে। নিজেকে নিয়ে বাঁচবে। হারিয়ে গেছে অনিমেষ হারিয়ে গেছে যৌবনের মূল দিনগুলো। তাতে কি? আবার বাঁচবে প্রাণ ভরে। বাকি দিনগুলো তার নতুন ভালোবাসাকে দেবে প্রাণ?