গানের ওপারে

Published By: Khabar India Online | Published On:

গানের ওপারে

প্রতিমা রায়।

ঘুমের ভেতরেই টের পেল গন্ধটা। গরম তেলের উপর গরম মসলা ফোড়ন। তারপর মাছের ঝোলের ম ম গন্ধ। উঃ সক্কাল সক্কাল!

যাঃ গরম। জানালাগুলো রাতের থেকে খোলাই ছিল। তাতেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে পাক খেয়ে খেয়ে গন্ধটা এ ফ্ল্যাটে ঢুকে ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। গায়ের ঢাকাটা আরো একটু টেনে নিয়ে তার ভেতর সরীসৃপের মতো ঢুকে গেল ঋজু। উদ্দেশ্য আরো এক প্রস্থ ঘুমানো। কিন্তু তা আর হলো না। ফোনের অ্যালার্ম বেজে উঠল মিষ্টি সুর করে। ঘুম চোখেই বিছানায় হাতড়ে ফোনটা নিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে, উঠে পড়ে। অফিস যেতে হবে।
হাত মুখ ধুয়ে স্নান সেরে নেয়। ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি মানদা মাসিকে দেওয়া আছে। সকালে রান্না করে খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে।
পরিপাটি হয়ে ঋজু টেবিলে বসে। ট্যালট্যালে ঝোল আর সবজি। মুখটা চামসে আমলকির মতো হয়ে গেল। অগত্যা অল্প দুটো খেয়ে, চশমাটা পরে ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে পা রাখে। পাশের ফ্ল্যাটের খোলা দরজার পর্দা হাওয়ায় অল্প অল্প উড়ছে, লনসাইডের অমলতাস গাছটায় কোকিল ডেকে উঠল-কুহু। ঋজু নীচে নেমে আসে।

আরও পড়ুন -  অবৈধ সম্পর্কের জেরে খুন এক যুবক

শেষ চৈত্রের রোদ্দুর এরই মধ্যে তার সবটুকু রক্তিমা যেন ঢেলে দিচ্ছে । গরমে আলজিভ পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। ট্রেন থেকে কোন রকমে নেমে রিক্সা নিয়ে সোজা অফিস। ততক্ষণে কপালে ঘাড়ে চুইয়ে চুইয়ে নামছে লবণাক্ত স্বেদ ধারা। সিলিং ধরে লম্বা হয়ে ঝুলে থাকা ফ্যানটাকে বড় দায়িত্ব জ্ঞানহীন মনে করে নিজের চেয়ারে এসে বসে ঋজু। তারপরই কর্নারে পাঁচ নম্বর টেবিলের দিকে চোখ চলে যায়।

পাশের টেবিলের রঞ্জুদা একটু গলা পরিস্কার করে বললে- পাখি এখনো আসেনি।

বাইরের টুকটুকে লাল সূর্যের চেয়েও ঋভুর গাল দুটি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। অবশ্য এ দু’বছরে নিজের টেবিল থেকে মাত্র চারটে টেবিল দূরে মধুমিতা দেবনাথের টেবিল, এ টুকু দূরত্ব তারপক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। শুধু গতবছর জন্মদিনে কেক কেটে একটুকরো দিতে এলে বলতে পেরেছিল- লালশাড়িতে আপনাকে দারুণ লাগছে।

মধুমিতাও হেসেছিল। হাসিতে যে প্রশয় ছিল তা ঋজুর নজর এড়ায়নি।

ঘন্টা দুয়েক বাদে কাঁচ দিয়ে পার্টিশন করা ওপাশের রুম থেকে রিপনদা আসে ঋজুর কাছে একটা বিল নিয়ে কথা বলতে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে বলে- পাখির খবর জানো?

আরও পড়ুন -  একটি চিঠি

না। কেন মধুমিতার কিছু হয়েছে?

হবে কি ভাইয়া! গরম মসলার গন্ধের মতো সারা অফিসে এ খবরটা ম ম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।

অবাক বিস্ময়ে কালো ভ্রমরার মতো চোখ দুটো তুলে খজু বলে- কি খবর রিপনদা?

পাঁচ নম্বর টেবিল তিন দিন ছুটি নিয়েছে। আর বস সুনীল ভোরাও। কাল সন্ধ্যার ট্রেনে,,, হেঁ হেঁ। এই গরমে দার্জিলিং। জমে ক্ষীর।

সন্ধ্যার ফিরতি ট্রেনে জানলার পাশে বসে ঋজু। মনের সঙ্গে আজ আর বোঝাপড়া নেই। জানলার পাশে সার্সিটা তুলে দিতেই ট্রেনের সঙ্গেই চলা হাওয়া সুযোগ পেয়ে কামরায় ঢুকে পড়ে- পাখি, দার্জিলিং জমে ক্ষীর শব্দগুলো হাওয়ার সঙ্গে ঘুরপাক খেতে থাকে । ট্রেন চলতে থাকে- কুঁ ঝিকঝিক। সে আওয়াজের চেয়ে ও দ্রুত লয়ে চলে- পাখি- দার্জিলিং – জমে ক্ষীর ,,,। ঋজু হাতের তর্জনী ভাঁজ করে ঘাম মুছতে থাকে।

ধীর পায়ে পথটুকু হেঁটে এসে ফ্ল্যাটের দরজায় পা রাখে। কিন্তু এ গন্ধ! আবার গরম মসলার গন্ধ নাকে এসে লাগে। মাথাটা তিরিক করে গরম হয়ে যায়। কিন্তু দরজায় তালা লাগানো নেই। তবে কি মানদা ভুল করে,,,। ভেতরে ঢুকে ঋজু দেখে গোটাঘর গরম মসলার গন্ধে ম ম করছে। কিচেন থেকে সালোয়ারের ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে পাশের ফ্ল্যাটের লাবণ্য।

আরও পড়ুন -  Suvo Baishakh: প্রাণময় ও ঐশ্বর্যময় হোক ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

এ কি তুমি!
হাঁ মানদাকে বলে,,।
কিন্তু ফ্ল্যাটের ভেতরে কি করে?
কোন কিন্তু নয়। মাথা গরম আছে তো, বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঠান্ডা হয়ে আসুন। গরম গরম খাবারগুলো জুড়িয়ে যাবে। সকালে তো কিছু খেতে পারেননি।
কিন্তু তুমি!
আমি এখানে প্রায় আসি মানদাকে বলে।
মানে!

আপনার চোখে তো মাইনাস পাওয়ার মানে মাইওপিয়া। দূরের জিনিস অস্পষ্ট দেখবেন কাছের তো নয়। তাহলে কাছের জিনিস দেখেন না কেনো? কেন দূরের জিনিসের পেছনে দৌড়াচ্ছেন।,

কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় ঋজু। লাবণ্যর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। দেখে-কাজলটানা আয়তকার লাবণ্যর চোখ দুটিতে দুটি ছোট মুক্তোর বিন্দু টলটল করছে, লজ্জাবনত লাবণ্যর পানপাতার মতো সুন্দর মুখখানিতে খেলে যাচ্ছে অপূর্ব এক দ্যুতি।
মৃদুস্বরে ঋজু বলে- লা- ব- ণ্য!

ঠিক তখনই খোলা জানালার গরাদের বাধা পেরিয়ে ব্যালকনির দিকের ফ্ল্যাটের টিভি থেকে গান ভেসে আসে-দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে/ আমার সুরগুলি পায় তোমায়,,,,,।