রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের দিল্লি সফর, ভারতের সাথে ব্যবসা বাড়ানো নিয়ে তার প্রস্তাব, আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ৪০ মিনিট ধরে তার বৈঠক- এগুলো যে সেই উদ্বেগ বাড়িয়ে দেবে তাতে সন্দেহ নেই।
লাভরভ প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের একটি চিঠি তুলে দিয়েছেন। সেই চিঠিতে কি রয়েছে তা তিনি বলেননি। যেসব কথা লাভরভ বলেছেন, তাতে স্পষ্ট যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ভারতের সাথে ব্যবসা অব্যাহত রাখা তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
সেইসাথে, ইউক্রেন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান নিয়ে মস্কোর ‘কৃতজ্ঞতা’ তিনি খোলাখুলিই প্রকাশ করেছেন। লাভরভ বলেন, ভারত যে ইউক্রেন প্রশ্নে অন্য অনেকের মত ‘এক চোখা নীতি’ অনুসরণ না করে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েছে, তা নিয়ে তিনি কৃতজ্ঞ।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি ভারসাম্য চাই, যা টেকসই, আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ যে ভারত এই সমস্যাকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখছে।’
ডলার ছাড়াও বিভিন্ন মুদ্রায় দাম নেবে রাশিয়া। লাভরভ বলেন, ভারতের মত দেশগুলোর সাথে ব্যবসা বাড়াতে রাশিয়া ডলার এবং ইউরো বাদে অন্যান্য মুদ্রায় দাম নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তিনি বলেন, ‘ভারত যা কিনতে চায় সেটাই রাশিয়া বিক্রি করতে প্রস্তুত।’
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারত এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কোনো সমালোচনা করতে অস্বীকার করছে। রাশিয়ার নিন্দা করে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা এবং সাধারণ পরিষদে যে কয়টি প্রস্তাব উত্থাপন হয়েছে, ভারত তাতে ভোট দেয়নি।
ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে, বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে দিয়ে রাশিয়ার কাছে থেকে ৩০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কিনছে ভারত।
ব্লুমবার্গের এক রিপোর্ট বলছে, রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগেই তাদের উরাল গ্রেড তেল প্রতি ব্যারেলের জন্য ভারতকে মাত্র ৩৫ ডলার প্রস্তাব করেছে। রাশিয়া চাইছে এ বছরেই ভারত ১ কোটি ৫০ লাখ ব্যারেল কেনার চুক্তি করুক। এই প্রস্তাব নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে কথা চলছে।
আর এতেই পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন, উদ্বিগ্ন যে ভারতের এ উদ্যোগ অন্য অনেক দেশকে উৎসাহিত করবে এবং রাশিয়ার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা দুর্বল হয়ে পড়বে।
নিষেধাজ্ঞা ভাঙলে পরিণতি যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণেই হয়তো শুক্রবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারগেই লাভরভের দিল্লি সফরের আগের দিন রাতেই ভারতে যান ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। তার আগের দিন (বুধবার) দিল্লিতে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ডেপুটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দালিপ সিং।
ভারতে রুশ তেল কেনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ, ক্ষোভ চেপে রাখেননি দালিপ সিং। ভারতের কথা সরাসরি উল্লেখ না করলেও দালিপ সিং সতর্ক করেছেন, যেসব দেশ রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর চেষ্টা করবে- তাদের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ভারতকে সতর্ক করে তিনি এমন কথাও বলেছেন, ‘চীন যদি ভারতকে কখনো আক্রমণ করে তাহলে রাশিয়া সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না।’
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনও জয়শঙ্করকে টেলিফোন করেছেন।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস অবশ্য দিল্লিতে গিয়ে বলেছেন, ভারতকে কোনো ‘লেকচার’ দিতে তিনি আসেননি। বরং ‘ইউক্রেনের রুশ হামলার পর কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ভারতের মত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্য যে এখন জরুরী’- সে কথাই বলতে তিনি এসেছেন।
রাশিয়ার সাথে ব্যবসা না করার কোনো কথা না বললেও ব্রিটিশ মন্ত্রী বলেছেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা যাতে কাজ করে তা নিশ্চিত করতে ব্রিটেন খুবই উদ্বিগ্ন ।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই রাশিয়ার ব্যাংকগুলো যেন কাজ করতে না পারে, রাশিয়া যেন তাদের সোনার রিজার্ভ ব্যবহার করতে না পারে, রুশ জাহাজ যেন বিদেশী কোনো বন্দরে ভিড়তে না পারে।’
দিল্লিতে শুক্রবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর রাশিয়ার কাছ তেল কেনা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এমনকি মার্চ মাসেও রাশিয়া থেকে যে তেল ইউরোপ কিনেছে, ভারত তার ছিটেফোঁটাও কেনেনি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত যে রাশিয়ার ব্যাপারে একটি ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে, তার পেছনে এই দুই দেশের সম্পর্কের দীর্ঘ একটি ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনি এর পেছনে প্রযুক্তি এবং বিশেষ করে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর ভারতের নির্ভরতাও কাজ করছে। এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জামের ৭০ শতাংশ যোগানদাতা রাশিয়া।
ছবি: বিবিসি