সুমিত ঘোষ, মালদাঃ একঝলক দেখে মনে হবে লাউ বা সে ধরণের অন্য কোনও আনাজ ৷ কাছে গেলেই ধারণাটাই পালটে যাবে ৷ লাউ কিংবা চালকুমড়ো নয়, এ হল বাঙালির প্রিয় সবজি বেগুন ৷ লাউয়ের মতোই লম্বা ও সবুজ রঙ ৷ একেকটি ওজনে দেড় থেকে দুই কিলো কিংবা তারও বেশি ৷ চলতি ভাষায় এই বেগুন নবাবগঞ্জের বেগুন নামেই পরিচিত ৷ শীতের মরশুমে এই বেগুনের চাহিদা জেলা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিদেশেও ৷ যদিও এই বেগুন চাষের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে ৷
অনেক আগে রতুয়া ২ ব্লকের নাগরি নদীর ধারে কয়লাবাদ গ্রামে এই প্রজাতির বেগুন প্রথম চাষ হয়েছিল ৷ ধীরে ধীরে পুরাতন মালদা ও গাজোল ব্লকের কয়েকটি গ্রামে এই বেগুন চাষ ছড়িয়ে পড়ে ৷ ধোপদুরস্ত চেহারার জন্য এই বেগুনকে প্রথমে পলিয়া বেগুন নামেই চিনত সবাই ৷ সেই সময় জেলার প্রধান হাট ছিল পুরাতন মালদার নবাবগঞ্জে ৷ এই হাটেই পাইকাররা আসতেন ৷ ফলে এই বেগুন নিয়ে সেই হাটেই যেত চাষিরা ৷ এই জন্য ধীরে ধীরে এই বেগুন, নবাবগঞ্জের বেগুন নামে পরিচিতি পায় ৷
সময় বদলেছে ৷ কিন্তু বেগুনের কদর আগের মতোই রয়ে গিয়েছে ৷ তবে এখনও এই বেগুনের চাষ বিস্তৃতি পায়নি ৷ এর অন্যতম কারণ, এই বেগুনের চাষিরা চাষের কৌশল প্রকাশ করে না ৷ এমনকি এই বেগুনের বীজও তারা বাইরে বের করে না ৷ একাধিক বীজ তৈরির সংস্থা এই চাষিদের কাছে বিশেষ বেগুনের বীজ সংগ্রহ করতে গেলেও প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে ৷ তবে বর্তমানে কিছু নার্সারি নিজেদের উদ্যোগে এই প্রজাতির বেগুনের চারাগাছ বিক্রি করে ৷ যদিও সেটা নগণ্য ৷
নবাবগঞ্জের বেগুন এখন মালদার একটা ঐতিহ্য হয়েই দাঁড়িয়েছে ৷ চলতি মরশুমে রতুয়া ২ ব্লকের রাজাপুর গ্রামের মাত্র চারজন চাষি এই বেগুন চাষ করেছেন ৷ তাঁদেরই একজন ফটিক শেখ ৷ তিনি জানান, ”বর্তমানে এই বেগুন আমাদের এখানেই হয়ে থাকে ৷ এই চাষ সবাই করতে পারবেন না ৷ তবে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের পর এই বেগুনের বীজ শোধন করে উন্নতমানের করা প্রয়োজন ৷ এখন প্রতিটি বেগুন দেড় থেকে দুই কিলো ওজনের হয় ৷ আগে একেকটি বেগুনের ওজন অন্তত তিন কিলো হত ৷ কিন্তু ওজন এত হলেও বেগুনে বিচি থাকত না ৷ এখনও দু’কিলো ওজনের বেগুনে কোনও বিচি থাকে না ৷ এই বেগুন এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য এখন খরচ হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা ৷ তবে এই বেগুন চাষ অত্যন্ত লাভজনক ৷ প্রতি বিঘাতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হয় ৷ আমি ১৬ বছর ধরে এই বেগুনের চাষ করছি ৷ এবছর বেগুনের দাম অনেক বেশি ৷ পাইকারদের কাছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কিলো দরে বেগুন বিক্রি হয় ৷ খোলা বাজারে এই বেগুনের দাম কিলোপ্রতি ১০০ টাকাও হয়ে যায় ৷ এবার অতিবৃষ্টিতে বেশিরভাগ জমি নষ্ট হয়ে গিয়েছে ৷ তাই বেগুনের দাম এত বেশি ৷ এই বেগুন চাষের জন্য বিশেষ কৌশল রয়েছে ৷ তবে তা আমাদের গোপন ব্যাপার ৷”
ফটিক এই বেগুন চাষের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাতে না চাইলেও এটুকু নিশ্চিত, নবাবগঞ্জের বেগুন চাষের জন্য পলিমিশ্রিত দোঁয়াশ মাটি প্রয়োজন ৷ সেকারণেই এই প্রজাতির বেগুন চাষের জমিগুলি সবই নদীর ধারে ৷ রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করলে ফলন ভালো হয় ৷ বিশেষত গোবর সার এই বেগুন চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ৷ জমির চারপাশ এবং উপরের অংশ জাল দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে ৷ যাতে কোনও পাখি কিংবা জন্তু জমিতে প্রবেশ করতে না পারে ৷ রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব কীটনাশক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ৷ সবচেয়ে বড়ো বিষয়, জমিতে জল দাঁড়াতে দেওয়া চলবে না ৷ জলের পরিমাণ বেশি হলে বেগুন গাছ নষ্ট হয়ে যাবে ৷ কোন সময় কতটা জলের প্রয়োজন, একজন বিচক্ষণ চাষিই তা সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন ৷