সূর্য ওঠে তবুও

Published By: Khabar India Online | Published On:

সূর্য ওঠে তবুও

১।
গুলবাহার বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেনি। অকালে তার বাবা চলে গেলেন। বাবা দিনমজুর ছিলেন কিন্তু ভালোই কাজ পেতেন, বসে থাকতে হতো না। গায়ে-গতরে ভালো খাটতে পারতেন বলে চেয়ারম্যান বাড়িতে তো তার ডাক সব সময় পড়তোই। এজন্য আবার অনেকে তাকে ঈর্ষার চোখে দেখতো। ঈর্ষার চোখে দেখার অবশ্য আরও একটা কারণ ছিলো, গুলাবাহারদের বাড়ির পিছনে বেশ কতকটা জমি আছে তাদের, যা তার বাবা পৈত্রিক সুত্রেই পেয়েছিলেন।
সেই জমিটাতে গুলবাহারের মা একটার পর একটা সিজেনাল সবজী আবাদ করেন এবং তা হাটে বিক্রি করেন। ফলে সংসারে বেশ একটা বাড়তি আয় আসে। আর তাই গুলবাহারের পড়াশোনাটাও ভালোই চলছিলো।
তাদের এই ভালোথাকাটা গ্রামের অনেকে সহ্য করতে পারছিলেন না, বিশেষ করে তাদের গ্যাতিগোষ্টিরা। তারা প্রায় এক একেকজন এসে গুলবাহারের মাকে বলতেন, কি ব্যাপার, তোমরা যে গুলের বিয়ের কোন চিন্তায়ই করছো না? মেয়ে দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ ভালোই, ক্লাস নাইনে পড়ে, আর কত? পরে না আবার মেয়ে নিয়ে কোন বিপদে-আপদে পড়ো! গ্রামের যে ছেলেছোকড়া; কার না কার কুচোখে পড়ে!
গুলবাহারের মা কখনো কারো সাথে তর্ক-বিতর্কে জান না। তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন মেয়েকে ভালোভাবেই পড়াশোনা করাবেন, তারপর সরকারী চাকুরিওয়ালা পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিবেন।
তাই কেউ কিছু বললে, তিনি শুধু বলেন, হা, তাই তো, মেয়ে তো বড় হচ্ছেই। দেখি, ভালো ছেলে পেলে কেন বিয়ে দেবো না। ফলে গুলবাহারের বিয়ে নিয়ে কথা আর এগোয় না।
গুলবাহার আড়াল থেকে এসব কথা সবেই শোনে আর হাসে, একটু পর পর নিজেকে আয়নায় দেখে, ঠিক করা চুল আবার ঠিক করে, কাজলের ওপর আবার কাজল টানে। অকারণ জীব বের করে নিজেকে ভ্যাংচায়, খিলখিল করে হেসে ওঠে।
তার মা সে হাসি শুনে চিৎকার করে ওঠেন; কিরে বাহার, কি হলো, ওমন করে হাসছিস কেন?
গুলবাহার হাসি থামিয়ে জীবে কামড় দিয়ে বলে, না মা, কিছু না, এমনি।
ওমন করে হাসিস না মা, বুকে ধক্ক করে লাগে। আশেপাশের মানুষের কান-চোখ খুব একটা ভালো নারে মা। গ্রামে ঘরে একটা সুন্দর ডাঙ্গর মাইয়া থাকার বড় জ্বালা!
গুলবাহার তার মায়ের কথায় কোন কান দেয় না, সে তার জগতে ভেসে বেড়ায়। ইদানিং তার পড়ায়ও মনঃ বসে না। শুধু রিপন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। পড়তে গেলে শুধু তার মুখ ভেসে ওঠে। কিযে করবে সে ভেবে পায় না।
রিপন চেয়ারম্যানের ছোটছেলে, গুলবাহারের সাথে একই স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে। ছোটবেলা একসাথে কত খেলেধুলা করেছে, চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে কতবার বরবউ সেজেছে। কিন্তু সে তো ছিলো ছেলেবেলার কথা। এখন এই সদ্য কৈশোর পেরোনো দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ভিন্ন এক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তা গ্রামের কেউ জানে না।
রিপন গুলবাহারকে বার বার সাবধান করেছে, তাদের সম্পর্ক যেন খুব গোপন থাকে, এখন জানাজানি হলে তার আব্বা তাকে খুন করে ফেলবে। তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে আর সম্পর্কও ঠিক রাখতে হবে এবং পড়াশোনাটাও করতে হবে, তারপর বড় হয়ে যা হবার হবে। তারা দুজন সেভাবেই সাবধানতার সাথে চলাফেরা করছে আজ একবছরের মতো হলো।
কিন্তু আজ একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটে গেছে, তাই গুলবাহার একটু বেশি বেশামাল হয়ে পড়েছে নিজেকে নিয়ে।ভালো হলো, নাকি খুব খারাপ হলো তা বুঝতে পারছে না, শুধু অন্যরকম অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
আজ স্কুলের টিফিন প্রিয়টে রিপন হটাৎ তার কাছে এসে হাত ধরে টেনে স্কুলের পিছনে পুকুর পাড়ের দিকে নিয়ে যায়।
গুলবাহার তার বান্ধবীদের মাঝ থেকে এভাবে নিয়ে আসায় প্রথমে খুব অবাক হয়! কি ব্যাপার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? কেনোই বা এমন করছো? সবাই কি ভাবলো বলোতো?
ভাবুব, এক আধদিন ভাবলে কিছু হবে না। তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো, তাই নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে লিটন দেখিয়েছে, তার মোবাইল থেকে ভিডিওটা আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়েছে।
লিটন! তোমার খচ্চর বন্ধুটা? তোমাকে না বলেছি ওর সাথে মিশবে না! বেয়াদপ ছেলে একটা! আর তুমি মোবাইল পেলে কোথায়? তোমার তো মোবাইল ছিলো না?
আরে বাবা এত কথা বলছো কেন? মার কাছে টাকা নিয়ে আমি কিনেছি, খুব গোপনে রাখি, যাতে আব্বার চোখে না পড়ে।
রিপন গুলবাহারকে নিয়ে স্কুলের পিছনে পুকুরপাড়ে একটা কুঁড়েঘর আছে, পুকুরের মাছপাহারাদার থাকে, সেখানে নিয়ে যায়। পাহারাদারটা দিনের বেলা থাকে না, বাড়িতে যায়। ঘরে একটা চৌকি ছাড়া তেমন কিছু নেই বলে দরোজা খোলাই থাকে। তাই এই কুঁড়েঘরটাই রিপন নিরাপদ মনে করে।
বাহার দেখবি জিনিসটা?
কি দেখি?
রিপন মোবাইলটা প্যান্টের ভেতর পকেট থেকে বের করে একটা ভিডিও চালু করে গুলবাহারের চোখের সামনে তুলে ধরে। গুলবাহার প্রথমে বুঝতে পারে না, তাদের বাড়িতে কারো মোবাইল নেই, তাই কৌতুহলী হয়ে সে রিপনের হাত থেকে মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে দেখা শুরু করে, কিন্তু একটু ভালোভাবে দেখতে গিয়ে দেখে যে, পোশাক ছাড়া উলজ্ঞ দুটো নারীপুরুষ একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করছে; ভয়ে লজ্জায় গুলবাহার কুঁকড়ে ওঠে, এটা কি রিপন? এটা কি দেখছো তুমি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ
প্লিজ বাহার, সোনা আমার চিৎকার করোনা না, প্রেম করলে একসাথে এগুলো দেখা যায়, আর আমরা তো কিছুদিন পর বিয়ে করবোই। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? আমার ভালোবাসায় তোমার বিশ্বাস নেই?
গুলবাহার এবার নরমসুরে বলে, কেন তোমাকে বিশ্বাস করবো না, আমি যে তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু বিয়ের আগে এসব দেখা ঠিক না। পাপ!
আসল প্রেমে কোন পাপ থাকে না জানো, সব পবিত্র, তুমি আমার কাছে বসো, এসো দুজনে একসাথে দেখি। বলতে বলতে রিপন গুলবাহারের হাতধরে কাছে টেনে নিয়ে খরপাতা মেঝেতে বসে।
তারপর ভিডিওটি দেখতে দেখতে কখন দুজনের উঠতি ভরাট শরীর বিভোর হয়ে যায়, তা তারা কেউই বুঝতে পারে না বা বোধ থাকে না।
দুজনেই শারীরিক পরিতৃপ্তির পর হটাতেই ধড়পড় করে উঠে দাঁড়ায়। গুলবাহার কাপড় ঠিক করতে করতে কেঁদে ওঠে, কি হবে এখন? আমরা এটা কি করলাম? যদি কোন অঘটন ঘটে?
কি বলো, কি অঘটন? তুমি ভয় পেয়েও না, কেউ কোনদিন জানবে না। আর আমরা তো একসময় বিয়ে করবোই।
তুমি কি বুঝতে পারছো না, বিয়ের আগেই যদি বাচ্চা আসে পেটে, আমার তো ক্লাস সেভেন থেকে মাসিক হয় নিয়মিত। তুমি কি জানো না, এভাবে মেলামেশা করলে সন্তান আসে?
আ-হা-রে জানি তো, কিন্তু একবার করলেই কি আর তা হয় নাকি পাগল? রিপন গুলবাহারকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে কথা দেয়, তোমার কোন ক্ষতি হতে দেবো না আমি। আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো। তুমি আমাকে সব সময় বিশ্বাস করবে।
Shofia
Shofia B Sheule
২।
ঘটানার দুমাস পর, জুম্মার নামাজ পড়ে গুলবাহারের বাবা বউ-মেয়েকে সাথে নিয়ে দুপুরের খাওয়া একসাথে খেয়ে উঠে একদিন বললেন, বাহারের মা, শোনো, আমি বাহারের বিয়ে দিতে চাই। সবার এত কথা আর ভালো লাগে না, তুমি কি বলো?
আমি আর কি বলবো, মানুষ তো ঘরে বেটি থাকলে অমন বলবেই, তবে আপনি যদি বিয়ে দিতে চান তো চাকুরিওয়ালা পাত্র খুঁজে আনেন, আমার আপত্তি নাই।
আমরা গরিব মানুষ, চাইলেই কি আর চাকরিওয়ালা পাত্র জুটবে?
আপনি আগেই এতো হতাশ হচ্ছেন কেন? খুঁজতে থাকেন, মেয়েও স্কুল পাসটা দিক, এই তো আর একবছর, দেখতে দেখতে চলে যাবে।
ঠিকআছে, তোমার কথাই সই। তা আমাকে একটু পান দাও, মুখটা জানি কেমন লাগছে, একটু শুয়ে থাকবো।
আপনি তো দুপুরে কোনদিন ঘুমান না? আজ আবার কি হলো? শরীর ঠিক আছে তো? বলতে বলতে গুলবাহারের মা তাঁর স্বামীর গায়ে মাথায় হাত বুলান।
না না চিন্তা করোনা, শরীর ঠিকই আছে, বুকটা আর ঘারটায় কেন জানি একটু চিনচিনে ব্যাথা ব্যাথা লাগছে, ও ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু গুলবাহারের বাবা আর জাগলেন না সেদিন, সেই ঘুমেই তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। গুলবাহারের মা এই আকস্মিক ব্যাথা কিছুতেই সামলাতে পারছেন না, তাঁর স্বামীর দিনমজুরের কাজে তাদের দিন ভালো চললেও, জমানোতো তেমন কিছুই নেই। তারপর আবার মেয়েটার বিয়েও তো দেয়া হয়নি; মনের স্বপ্ন মাঝপথে এভাবে ধাক্কা খাওয়ায় তিনি গুলবাহারকে বললেন, তুই আপাতত বাড়িতে পড়াশোনা কর, এখন তোর বাবা নেই, দুটা মেয়ে মানুষ আমরা, তোর বাইরে বেশি চলাফেরা না করাই ভালো। ফাইনাল পরীক্ষার সময় যেভাবে হোক আমি পরীক্ষা দেয়ার ব্যাবস্থা করবো।স্কুলের মাষ্টারদের সাথে তিনি কথাও বলে এলেন সেভাবেই।

আরও পড়ুন -  নারী রূপেণ সংস্থিতা, দুর্গা রূপেণ সংস্থিতা

এদিকে দুমাস পেড়িয়ে তিন মাস হলো, গুলবাহারের মাসিক হয়নি। গুলবাহার তিনমাসেও মাসিক না হওয়াতে খুব ভয় পেয়ে গেলো। আজকাল তার খাওয়াতেও রুচি নেই, কেমন বমি বমি লাগে খাবার দেখলে। মাকে বলবে বলবে করেও বলতে পারছে না, এমনিতেই হটাৎ বাবা চলে গিয়ে মার যে অবস্থ্যা! কিন্তু কি করবে, সেটাও বুঝতে পারছে না।
দুপুরে খেতে বসে আজ আর গুলবাহার খাবার মুখেই তুলতে পারলো না। তার আগেই বমি চলে এলো। সে দৌড়ে কলতলায় গিয়ে বমির চেষ্টা করতে লাগলো, বমি ঠিকমতো হচ্ছে না, মাথাটাও খুব ঘুড়াচ্ছে, সে সেখানেই ধপ করে মাথা চিপে বসে পড়লো।
গুলবাহারের মা দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলেন, কি হয়েছে বাহার তোর? কি হলো হটাৎ মা?
কি জানি মা, বুঝতে পারছি না, মাথাটা খুব ঘুরছে, আমাকে একটু বিছানায় নিয়ে চলো, আমি উঠতে পারছি না।
বাহারের মা মেয়েকে তুলে ধরে নিয়ে যেতে যেতে মেয়েকে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে লাগলেন। তাঁর অভিজ্ঞ চোখে ঠিকই অনাকাঙ্ক্ষিত আশঙ্কা ধরা পড়লো।
বাহারকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে তিনি মাথা ঝুঁকে বলতে লাগলেন, আমাকে ঠিক করে বল, তুই কোথায় কি করেছিস? ঠিক করে বল পোড়ামুখি কার সাথে কি করেছিস? ঐ …ঐ হারামী তোর মাসিক কয়মাস হলো হয় না?
কেন, কি হয়েছে মা? এই মাসসহ তিনমাস হচ্ছে, মাসিক হয় না।
কি … কী … বললি তুই! শেষ সব শেষ, তোর বাপ মরার দুইমাসও হয়নি, এর মধ্যেই তুই আমার মরার ব্যাবস্থা করে রাখলি, ওড়ে হারামী এখন কি হবে?
গুলবাহারের মা পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলেন, হাতের কাছে যা পেলেন তাই দিয়েই ঝপাং ঝপাং করে মাড়তে লাগলেন, মর মর তুই! বল বল কে এই সর্বনাস করলো?
গুলবাহার মুখ চিপেধরে কাঁদতে কাঁদতে রিপনের সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা মাকে বলেই ফেলল।
গুলবাহারের মা শুনে তো মাথায় হাত দিলেন, রিপন চেয়ারম্যানের ছেলে, কি করে? কি করে সমাধান হবে এর? তবুও তিনি তখন তখনেই বাড়িতে মেয়েকে তালা দিয়ে রেখে ছুটলেন চেয়ারম্যানের বাড়ি। গিয়ে চেয়ারম্যানের বউয়ের পায়ে ধপ করে পড়লেন, আপনি আমাকে বাঁচান, আপনি আমার মেয়েটাকে বাঁচান!
কেন কি হয়েছে? গুলের মা, গুলবাহারের কি হয়েছে? কান্না থামাও, আগে বলো কি হয়েছে।
গুলবাহারের মা, রিপনের মাকে সব খুলে বলেন। গুলবাহারের মায়ের কান্নার আওয়াজ পেয়ে চেয়ারম্যান ও রিপন দুজনেই ছুটে এসে দরোজার কাছে দাঁড়ায়, ফলে তারাও সব শুনতে পায়। রিপন সব শোনার পর আর সেখানে না দাঁড়িয়ে সড়ে পড়ে।
ঘটনা শোনার পর, রিপনের মা হতবম্ব হয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই চেয়ারম্যান চিৎকার করে ওঠেন, নষ্টামী করার আর জায়গা পেলে না? তোমার এতো দুঃসাহস! তুমি তোমার নষ্টা মেয়েকে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপাতে চাও? স্বামী মরার মাত্র কয়টা দিন গেলো, এরমধ্যেই মা-মেয়ে শরীর বেচানোর দোকান খুলেছো? দূর হও! দূর হও এখান থেকে, ওড়ে কে আছিস, এটাকে বের করে দে বাড়ি থেকে! আর শোনো, এ নিয়ে যদি আমি আর একটা কথা শুনি তো, তোমাদের বাড়ি-ভিটে ছাড়া করতে আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না!
ভয়ে কষ্টে গুলবাহারের মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বাড়ি চলে আসেন। কিন্তু ঘটনা আর এক জায়গায় থাকলো না, ছড়িয়ে গেলো গোটাগ্রাম। আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাই বাড়ি বয়ে এসে ভর্তসনা করতে কেউ আর পিছপা হলেন না। আর যত জঘন্য ভাষার গালি আছে তা দিতেও কমতি করলেন না।
শেষে সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন এদের এক ঘরে করে দাও। কেউ ওদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখবে না। শুধু গুলবাহারের দাদা বয়সের এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বললেন, তোমরা যদি রাজি থাকো তো আমি গুলবাহার ও তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই, তোমাদের চাচি তো বাতের ব্যাথায় আর আমার তেমন সেবাযত্নই করতে পারে না।
কেউ কিছু বলার আগেই লিটন এসে সামনে দাঁড়ালো, তোমার লজ্জা করে না আব্বা! বেলজ্জার মতো কথা বলছো মা বেঁচে থাকতেই, দাঁড়াও আমি মাকে ডেকে আমি।
বৃদ্ধা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে যান।
লিটন সবার দিকে মুখ করে ভাষণ দেয়ার মতো করে হাত তুলে বলল, উপস্থিত তোমরা সবাই শোনো, তোমরা সবাই অমানুষ! তোমরা কি করে শুধু গুলবাহারের দোষ দেখছো? এর সাথে যে এক পুরুষ মানুষ জড়িত, কেউ তো তাঁর কথা বলছো না? কেন, সে বড়লোকের পোলা? যাও দূর হয়ে যাও সবাই, তোমাদের কাউকে লাগবে না, আমি সবসময় গুলবাহারের পাশে আছি, কেউ যাতে তাঁর কোন ক্ষতি করতে না পারে সেটা আমি দেখবো। আর তোমরা তো জানোই আমি কেমন খারাপ পোংটা পোলা! যতদিন পর্যন্ত ঐ বড়লোকের … পোলা গুলবাহারকে স্বীকার করে না নেবে ততদিন আমি তারে খুঁজে বেড়াবো কোথায় লুকায় আছে সে!
জনতার মধ্যেথেকে কে একজন বলে উঠলো, তুমি এতো জোরদিয়ে কেমনে বলো, যে কাজটা রিপনেই করছে, অন্যকেউই তো হতে পারে? এরা টাকা খাওয়ার লোভে বড়লোকের নামে দুর্নাম দিচ্ছে?
লিটন চিৎকার করে উঠলো, কে কে রে, এই কথা বলল? শালা…তুই বেশি জানিস? আমি সাক্ষী, আমি প্রমাণ; এই কাজ রিপনের। রিপন আমার সামনে এসে বলুক দেখি, কেমনে বলে, সে কাজটা করেনি! তারপর লিটন গুলবাহারের মেয়ের হাতে হাত রেখে বলে, চাচি, তুমি কোন চিন্তা করবে না, যা হবার হয়ে গেছে; গুলবাহারকে আর কিছু বলো না, ভুল কি মানুষ জেনে-বুঝে করে? তোমার যখন দরকার হবে, আমাকে ডাকবে। আমি আমার সাধ্যমতো তোমাদের সাথে আছি।তোমার সবজী এরা কিনবে না; তো কি হয়েছে? শহরে নিয়ে গিয়ে বেঁচে আসবে। ডাইরেক বাস যায় এখান থেকে, চিন্তা করো না। আর ঐ রিপনকেও আমি নিয়ে আসবোই, তুমি দেখে নিও।
গুলবাহার ঘরের দরোজার আড়াল থেকে এবার সাহস করে বেরিয়ে এসে লিটনকে বলে, লিটনভাই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, এতদিন কত গালমন্দ করেছি তোমায়। আজ তুমি যা করলে, তা আপন ভাই থাকলেও করতো কিনা জানি না?
দূর পাগলী, এভাবে বলার কিছু নেই, আমি তো দুষ্টু পোলাপাইনেই। বলে লিটন হেসে ওঠে, তুই চিন্তা করিস না, সাবধানে থাকিস বোন। আমি এখন যাই, চাচি আমার মোবাইল নম্বরটা রেখে দাও।

আরও পড়ুন -  বাঁকুড়া জেলায় পুলিশের সহায়তায় ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবির

৩। কিন্তু এরপরেও দু, তিন মাস চলে যায়, রিপনকে আর লিটন খুঁজে পায় না। লোক মুখে শোনা যায়, রিপনকে নাকি তার আব্বা তার মামাবাড়ি থেকেই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। লিটন শুকনো মুখে এসে গুলবাহারদের খোঁজ খবর নিয়ে যায়। এদিকে গুলবাহারের পেট প্রকাশ্যে জানান দিচ্ছে যে, সেখানে শিশুটি ভালোভাবেই বেড়ে উঠছে। গুলবাহারের মা সেটা গুলবাহারের মা সেটা দেখে আরও কাঁদতে কাঁদতে চোখ ঝাপসা করে ফেলেছেন, এই সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে আল্লাহ? বাপের পরিচয় ছাড়া সে কেমনে দুনিয়াতে এসে বেঁচে থাকবে?
লিটন আজ কয়েকদিন ধরেই একটা ভাবনা ভেবে চলছে, যদি গুলবাহারের কোন উপকার আমি করতে চাই; তো এভাবে তো আর কোন উপকার হচ্ছে না! বাচ্চাটা দুনিয়াতে এলে যে গুলবাহার আরও বিপদে পড়বে আর বাচ্চাটাই বা বিনা বাপের পরিচয়ে কেমন করে বড় হবে?
তাই সে অনেক ভাবাভাবি করে গুলবাহারদের বাড়ি এসে তার মায়ের কাছে জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো।
তাকে দেখে গুলবাহারের মা মুখে আঁচল চেপে আবার কান্না জুড়ে দিলেন, বাবা ঐ হতভাগীর এখন কি হবে রে বাবা? তুই বললি যে ঐ শয়তান রিপনকে ধরে আনবি। সেটা তো আর হলো না, অথচ বাচ্চাটা যে হওয়ার সময় হয়ে আসতেছে! এখন কি হবে বাবা? তুই বরং আমাকেই বিষ এনে দে, আমি মরলে ঐ হতভাগী কি করে করুক; খারাপ পথে যাওয়ার আগে হুশ ছিল না যখন, তখন তার কপাল নিয়ে সে পড়ে থাক!
লিটন কাঁচুমাচু করে বলল, চাচি তুমি অতো ভেবো না; কান্নাকাটি বন্ধ কর।আমি যখন কথা দিয়েছি যে আমি গুলবাহারের পাশে আছি, তখন আমি তার পাশে থাকবোই।
কিন্তু বাবা তুই পাশে থেকে কি আর বাচ্চাটা তার বাপকে পাবে? সে তো পালায় গেছে?
চাচি তুমি যদি রাজি থাকো এবং গুলবাহার যদি অমত না করে তাহলে আমি গুলবাহারের সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই, এবং গুলবাহারকে তার যোগ্য সম্মান দিয়েই আমি তার সন্তানের বাবা হতে চাই।
কি বলছিস তুই? তোর বাপ মা শুনলে তোকে বাড়ি থেকে বের করেই দেবে না, তোকে ত্যাজ্য করবে তারা?
আমি সেটাতে কোন ভয় পাইনা। আমি এমনিও তাঁদের চোখে ভালো ছেলে না, গুন্ডামি বদমাইশি করে বেড়াই।এখন তুমি রাজি আছো কি না বলো?
গুলবাহারের মা কি বলবে বুঝতে পারছে না; খুব আনন্দেই বুঝি তিনি বোবা হয়ে গেলেন। তাঁর বুক থেকে একটা বোঝা যেন নেমে গেলো। হোক গুন্ডা, হোক বদমাইশ, পড়াশোনা না করুক, মজুর করে খাবে; কিন্তু গুলবাহারের সন্তান পিতার পরিচয় তো পাবে। তিনি খুশীতে আত্মহারা হয়ে কোনরকমে বললেন, বাবা তুই একবার গুলবাহারের সাথে কথা বলে নে।
লিটন বলল, হা অবশ্যই।
গুলবাহার ঘর থেকে তার মা আর লিটনের সব কথাই শুনতে পেয়েছে। তাই লিটন যখন ঘরে ঢুকে গুলবাহারের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, গুলবাহার আমি তোকে একটা কথা বলতে চাই, রাখা না রাখা তোর ব্যপার। যেটা ভালো বুঝবি করবি।
গুলবাহার বিছানা ছেড়ে উঠে বসে একটা হাত বাড়িয়ে লিটনের একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, রিপন ঘুরে এলেও তাকে গ্রহন করার কোন ইচ্ছে আমার মনথেকে আসছিল না, যা করতাম তা হয়তো শুধু এই সন্তানের কথা ভেবে, কিন্তু তুমি আজ যা আমাকে সব জেনে শুনে বলতে এসেছো? তা আমার পরমভাগ্য হিসেবেই আমি গ্রহণ করবো। আমি তোমাদের কথা সব শুনেছি। আমাকে আর তোমার কিছু বলতে হবে না। জীবনের এই এক ঘটনা আমার বয়েস অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক, সেই অভিজ্ঞতায় বলছি, তোমাকে আমার সন্তানের পিতা হিসেবে পাওয়াটা আমার সন্তানের বড় ভাগ্য এবং আমারও।
লিটন গুলবাহারের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল, দেখিস গুলবাহার, আমি খুব ভালো বাবা হবো তোর সন্তানের; তোর কোন অভিযোগ থাকবে না।
রাতের মধ্যেই গুলবাহার আর লিটনের বিয়ে হয়ে গেলো। লিটনের বন্ধুরাই সব ব্যবস্থা করেছে। তার বাবা মা যথারীতি তাকে বলে দিয়েছে, ‘লিটন যেন তার বউ নিয়ে বাড়ির গেটে পা দেয়ার চিন্তা ভুল করেও না করে। তাঁরা তাঁদের ছেলে লিটনকে সবার সামনে মৃত ঘোষণা করে দিয়েছে।’
লিটন অবশ্য আগে থেকেই জানতো যে, এমটা হবেই তাই সে তার বাবা মায়ের কথায় দুঃখ ব্যাথা কিছুই পেলো না। বরং সে মনের সুখে নতুন বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থেকে গেলো। এতে গুলবাহারের মাও খুব খুশী।

আরও পড়ুন -  T20 World Cup: সুপার টুয়েলভে জিম্বাবুয়ে, স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে
সুফিয়া শিউলি। লেখিকা। বাংলাদেশ।

ভোরের আলোয় আজ অনেকদিন পর গুলবাহার বাড়ির সামনের সড়ক থেকে একটু হেঁটে এলো।কেউ কেউ কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল, সে কোন পাত্তাই দেয়নি। বাড়িতে এসে বারান্দায় বসে মাথার ওপরের বিশাল আকাশটার দিকে তাকালো। হটাৎ একটা কাক কা কা করে নিস্তব্ধতা ভেংগে দিয়ে গেলো… । গুলবাহার বিশাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, দুনিয়াতে সবাই খারাপ না…..।
বেলা ওঠে…বেলা বয়ে যায়…গুলবাহারের মা পান চিবোতে চিবোতে বলেন, যা হলো, অনেক ভালো হলো… এখন সব ঠিক হয়ে যাবে বল?
হু…হয়তো……।
হু হয়তো আবার কি! হলে হোক, না হলে নাই!
মা আবার একটা পান মুখে দেয়। পানের রসে রাঙা ঠোটে মা আবার বলে ওঠেন, না হলে আর কি করা যাবে বল; তবুও মানুষ কি আর স্বপ্ন দেখা ছাড়ে…? বেঁচে থাকতে হবে…।
কিছুক্ষণ পর মা আবার বলে ওঠেন, শোন এভাবে গোজ হয়ে বসে না থেকে নিজের ভেতর যে শক্তি ও ক্ষমতাটুকু আছে সেটা দিয়েই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর! কারো জন্য আর মনে আর কোন কষ্ট রাখবি না। যে সম্মান দিতে জানে না তারজন্য হুঁকো সাজিয়ে তাকে আপ্যায়ন করার জন্য বসে থাকার মধ্যে কি আর নিজের সম্মান থাকে? নাকি নারীত্বের ক্ষমতার অহংকার থাকে? বরং ব্যাক্তিত্ব খাটো করে নিচু হয়ে বেঁচে থাকতে হয়! তারথেকে যে তোকে সম্মান দিয়ে আজ তোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার কথা ভাব্বি, তাঁর সম্মানের কথা চিন্তা করবি। কারো কাছে কোনভাবে আর মাথা নত করবি না। যে দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে গে্লো, এ সমাজ তাকে তো কিছু বল্লো না? দুজনের ভালোবাসায় যে আসছে, সে কি তোর একার কারণে? এই ভীরু স্বার্থপর সমাজটার মুখে লাথি মারি! তুই আর ভয় বা লজ্জা পেয়ে চলবি না! তোর পাশে লিটন আছে, আমি আছি তোর পাশে, আমি তোর মা…।
গুলবাহার খুব অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো, মা এত সাহসী হয়ে গেলো? যখন সবাই তাঁর কুমারী মেয়ের গর্ভধারনকে ধিক্কার জানিয়েছে, তখন সে কত অপমানিত হয়েছে সবার কাছে! অথচ আজ শুধু লিটনের জন্যেই মা এত সাহসী হয়ে উঠলো? তাহলে আমার আর কি কোন ভয় পাওয়ার আছে? মা ঠিকই বলেছে। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তো কি হয়েছে; আমার দেহে যে আর একজন হাত-পা ছুড়ে তার অবস্থান জানান দিচ্ছে, তাকে তো আমাকেই এই পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে! সে আমার… সে শুধু আমার…।
এই এতটুকু ভেবে গুলবাহার তার পেটে হাত রেখে এক দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করলো…… সে মা হতে যাচ্ছে! তাকেও তার সন্তানকে রক্ষা করতে হবে……