অন্নঋণ শোধ

Published By: Khabar India Online | Published On:

খবরইন্ডিয়াঅনলাইনঃ

অন্নঋণ শোধ

ICU-র বাইরে লালআলোয় লেখা ‘keep silence please’ কথাটা জ্বলজ্বল করছে যদিও, তবুও রায়গিন্নী কেঁদে চলেছেন সমস্ত নিয়ম ও নীরবতা ভেঙে তছনছ করে ‘ মাগো ক্ষমা করে দে – নইলে যে মরে নরকেও ঠাঁই হবেনা আমার; মুখ্যু মেয়েমানুষ না-বুঝে কত অকথা কুকথাই বলেছি তোকে। তুই আমার সংসারের লক্ষ্মীপিতিমা, তবু তোকেই চিনতে পারিনি। ঠাকুর আমার সে পাপ ক্ষমা করেননি, মহা শাস্তি দিয়েছেন। আজ তুই না থাকলে আমার গোপালকে হারাতাম । তুই নিজের প্রাণ দিয়ে তার প্রাণটা বাঁচিয়ে প্রমাণ করে দিলি তোর স্থান সবার উপর।”

ICUর কাঁচের দরজার এপারে ৩নং বেডে তখন যমে মানুষের লড়াই – পেশেন্ট সারদামণি পঁচাশি শতাংশ জীবন্ত দগ্ধ দশায় কোমায় আচ্ছন্ন আর ওপারে উৎকন্ঠিত আতঙ্কিত মুখের ভীড়ের মাঝে শাশুড়িমা রায়গিন্নীর ভয়ার্ত বিলাপ । অনুচ্চারিত প্রশ্নটা বারবার তাকে তোলপাড় করছিল ”একি আত্মহত্যা? নাকি আত্মত্যাগ? নীরব প্রতিবাদ? নাকি প্রতিশোধ? এ’কি?”

আরও পড়ুন -  এই মাসেই শেষ ‘মিঠিঝোরা’! এল বড় সত্যি খবর

বিবাহের সাতবছরেও কুলপ্রদীপ জ্বালাতে না পেরে দৈনন্দিন অপমান লাঞ্ছনা গঞ্জনাকে বড় সহজে জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছিল সারদামণি। সাতবছর শ্বশুড়বাড়ীর অন্নধ্বংস করার মত গুরুতর অপরাধে অপরাধী যে ‘বাঁজা মেয়েমানুষ’ , তার কন্ঠে প্রতিবাদের ভাষা জোটেনা। রায়বাড়ীর রোজনামচা পূজার ঘটা, পালাপার্বন, হেঁশেলের হাঁড়িকলসী- সবকিছুই সযত্নে সুরক্ষিত বড়বৌ সারদার ‘অপবিত্তির ছোঁওয়া’ বাঁচিয়ে।

কালের রথচক্র ঘুরল- রায়গিন্নীমার মুখে আহ্লাদের রঙীন হাসি ফুটল- তার নয়নের মণি আদরের ‘গোপাল ঠাকুর’ এল ছোটবৌমার কোল আলো করে। আহা! এ’স্বর্গীয় আনন্দের বুঝি তুলনা নেই। তবু মনের কোণে আশঙ্কার কাঁটা বিঁধে – তার গোপালের উপর যেন ঐ বাঁজা ডাইনীর কালোছায়া না পড়ে; সারাক্ষণ বুকে আগলে রাখেন নাতি।বিধাতা অলক্ষ্যে বসে হাসলেন হয়তবা।

আরও পড়ুন -  পরিচয়

রায়বাড়ীর পূজার রোজনামচায় ঝক্কি বড় কম নয়; রোজসকালে ফুল মালা চন্দন ধূপ দীপ শঙ্খ ভোগ-প্রসাদ সাজিয়ে নিবেদন – সেএক কর্মযজ্ঞ বটে। নিত্যকার দেবসেবার ব্যস্ততায় আজ রায়গিন্নীর নজরে এলনা কখন তার কোলের গোপাল হামা দিয়ে নেমে গেছে। চঞ্চল শিশুমনকে আকর্ষণ করেছে পাশে রাখা পিলসুজের উপর ঘিয়ের প্রদীপ। তারপরের ঘটনা অতিদ্রুত ও সংক্ষিপ্ত। আতঙ্কিত আর্তচিৎকারে পরিপূর্ণ রায়বাড়ীতে তখন শুধু ‘গেল গেল’ রবের কান্না – গোপালকে ঘিরে লেলিহান অগ্নিশিখা চারপাশে; উদ্ধারের পথ খুঁজে পাচ্ছেনা দিশাহারা মানুষ। কোথায় ছিল সারদামণি, সমস্ত নিষেধের বেড়া ভেঙে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল; কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল গোপালকে।পিনপতন স্তব্ধতায় নিমেষে শান্ত হল কোলাহল।

আরও পড়ুন -  নদী পেরিয়ে

কুলপ্রদীপ রক্ষা পেলেও আগুন ততক্ষণে নিঃশব্দে গ্রাস করেছে সারদাকে। দিব্য বিভায় অদ্ভুদ অবর্ণনীয় এক হাসি সারদার মুখে; সাবধানে গোপালকে রায়গিন্নীর কোলে তুলে দিয়ে যখন সে শ্বশুড়বাড়ীর সাতবছরের অন্নঋণ শোধ করছে, তখন রায়গিন্নী মূর্ছা গেছেন, সারদার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে।

মৌলি বণিক। লেখিকা।

লেখালিখি তে যুক্ত দীর্ঘদিন। বহু পুস্তক ও পত্রিকায় সম্পাদনা য় যুক্ত। বাংলাদেশ থেকেও প্রকাশিত ও সম্পাদিত হয়েছে কাব্য গ্রন্থ। লেখিকা, বাচিক শিল্পী, সঞ্চালিকা আবৃত্তি, শ্রুতি নাটক ও সঞ্চালনা করি। বহু মঞ্চ অনুষ্ঠান ও অনলাইন অনুষ্ঠান।