খবরইন্ডিয়াঅনলাইনঃ
নদী পেরিয়ে
রোসমেরী উইলসন
নদী আসলে জল নিয়ে কেবল বয় না, নদী বয় মানুষের সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে। নদীর পাড় যখন ভাঙে, আসলে শুধুমাত্র পাড়ের বালি আর মাটি ভেঙে পড়ে না, তার সাথে ভাঙতে থাকে মানুষের বাড়ি, মানুষের চেনা ছাদ, মানুষের মন, মানুষের সংসার। তবু যারা জলে যায়, বনে যায়, তারা বেশ জানে জায়গা বদলানো এমন কি কঠিন, কিন্তু জীবিকা বদলানো গেলেও নেশা ছাড়া বড় কঠিন। নেশা শুধুমাত্র মাদকেই থাকে না, নেশা থাকে পুরোনো মাটির দেওয়ালের গায়ে, নেশা লাগে সকালে তুলসিমঞ্চের পাশের নয়নতারা গাছে প্রথম ফুল ধরলে। নেশা গ্রাস করে একটা মানুষকে নদীর কাঁকড়া ধরতে ধরতে, নেশা হয় বনের মৌচাক ভেঙে আনতে।
আমার এই গল্প বুধিয়াকে নিয়ে। নদীতে মাছ ধরে আর মায়ের সাথে সাথে কাঠ পাতা কুড়িয়ে এনে, কখনো বা কলমীর আঁটি দূরে নিয়ে মহাজনদের বাড়িতে বিক্রি করে যে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে বন পেরিয়ে দূরে বাবার সাথে নতুন রাজ্য দেখার এক অদম্য ইচ্ছা সত্যি করবে বলে। বুধিয়ার বাবা বনে যায় মধু আনতে। বুধিয়ার বাবা জঙ্গলে যখন যায় কয়েকদিন বাড়ি আসে না। আর ছোটো বুধিয়া হাঁ করে বসে থাকে বাবা কি বিচিত্র তথ্য নিয়ে ফিরে এসে রাতে কুপি জ্বেলে বসে বা বুধিয়ার পাশে শুয়ে নদীর দিকে চেয়ে চেয়ে তার প্রতিটি দিনের বিচিত্র বর্ণনা দেবে তার অপেক্ষা নিয়ে। বাবার কাছে গল্পে বুধিয়া শুনেছে কি করে বনফুলের গন্ধে চিনে নিতে হয় ঈষাণকোণে মেঘ করল কিনা, কি করে বুঝতে হয় আশেপাশে বনবিবির বাহন এসেছে নাকি। বুধিয়া বড়বড় চোখ করে বনবিবির গল্প শোনে, শোনে দেবীর অপার মহিমার কথা। মায়ের পূজার বাতাসা, হাতে লাগা চন্দনে সে জানে পৃথিবীতে আর কেউ না, একমাত্র কেউ যদি পূজ্য দেবী তাদের, তিনি দেবী মা।
বুধিয়ার মা বহুদিন পর বনবিবির মানত করে এক বুধবারে ছেলেকে পেয়েছে, আদর করে তাই ডাকে বুধিয়া বলে। সেই ছেলের বনে যাবার কথায় মায়ের মন আৎকে ওঠে ঘুমের ভেতর। পরিচিত বনের নিয়ম আর অজানা ভবিষ্যতের কথা ভয় হয়ে বুধিয়ার মাকে তাড়া করে বেড়ায় আজকাল সারাক্ষণ। বহু বার সে বুধিয়ার বাপকে বলেছে কলকাতা গিয়ে অন্য কোনো কাজ যদি করা যায়। বুধিয়ার বাপ রাজি, কিন্তু বুধিয়া অবোঝ। একবার শহরে মাসির বাড়ি তার মা রেখে এলে ক’দিনের মধ্যে বুধিয়া নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেয়, রোগে ধরে তাকে। বাধ্য হয়ে বুধিয়াকে তারা গ্রামে ফিরিয়ে আনে। সেই বুধিয়া আজ ষোলোয় পা দেবে। মা তাকে জামবাটিতে সামান্য পায়েস করে দিয়ে ছেলের পাশটাতে যখন এসে বসে, ঠিক সেসময় গ্রামের মোড়ল এসে জানিয়ে যায় বুধিয়া বড় হয়েছে, এই যাত্রায় বনে তারা বুধিয়াকেও নিয়ে যাবে মধু সংগ্রহ করে আনতে।
দিন আসে বনে রওনা দেবার। গ্রামের মেয়েদের পূজা শেষ হলে বুধিয়া আর বুধিয়ার বাবা বাকি সঙ্গীদের সাথে নদী পার করে আস্তে আস্তে দূরচক্রবালে মিলিয়ে যায়। যত পথ যায় বুধিয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, অন্ধকারে পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারা সূর্য যেন এক নতুন রাজ্য। বড় বড় চোখে বুধিয়া জংলি পশুর দ্রুত চলে যাওয়ার আওয়াজ শোনে, শোনে বিচিত্র প্রজাপতিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। এই জঙ্গলকে সে জন্ম থেকে চেয়েছে দেখতে, এ যেন তার নিজের জায়গা, যাদের সাথে সে এসেছে সে দল যেন তাকেই দেবতার সম্মান দিয়ে চলেছে প্রথম দিনটি থেকেই। তারা যত বুধিয়ার যত্ন করে, ফল জল এগিয়ে দেয় বুধিয়ার বাপ তত চুপ করে থাকে। বুধিয়া বাপের কোল ঘেঁষে বসলে বাপ দূর আকাশের দিকে নীরবে চেয়ে থাকে। বুধিয়া কষ্ট পায়, মুখে কিছু বলে না।
অবশেষে এক সকালে বুধিয়ার বাপ ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। দলের এক প্রবীণ বুধিয়াকে নিয়ে এগিয়ে যায় ওদিকে যে বিচিত্র নীল জঙ্গল তা দেখাবে বলে। বুধিয়ার বাপ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে নদীর দিকে মিশে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে। তার ইচ্ছে হয় নদীতে ছেলেকে না পাঠিয়ে, নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু জঙ্গলের নিয়ম ভাঙতে পারবে এত সাহস তার নেই, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে দুই পা মাটিতে গেঁথে। বনবিবির বাহনের তীব্র গন্ধ তখন সবার নাকের সামনে। মৃত্যু কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে নীরবতায়। বুধিয়া বাঘের গল্প শুনেছে, ছবিতে দেখেওছে। এতদিনের পূজ্য দেবী তার সামনে। সে জানে প্রতিবার দেবী আসে তার প্রাপ্য বুঝে নিতে, বুধিয়ার বাপ সে গল্প ছেলেকে করেছে। প্রতিবার একটি তাজা প্রাণ বনবিবিকে উৎসর্গ করে তবে দলের মানুষ গ্রামে ফেরে। এ যাত্রাতেও সে নিয়মের অন্যথা হয়নি। জ্বলন্ত দুটি চোখের সামনে বুধিয়া নড়তে পারে না। পিছনে তখন তার বন ডাকছে , নদীর পাড় ভাঙছে নতুন শ্রাবণে। আকাশের মেঘেরা ধুয়ে যাচ্ছে চাপ চাপ রক্ত আর বনফুল কুড়োবার নেশায়। বুধিয়ার বাপ শুনতে পায় হলুদ দেবী ভারি কিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। বুক চাপড়ে চেঁচাতে গিয়েও চুপ করে যায়। তার মনে পড়ে কতবার ছেলেকে ইস্কুলে পাঠাতে চেয়েছে সে, কিন্তু বুধিয়ার এক গোঁ, সে বন দেখতে চায়, সে নদীতে ঝাঁপাতে চায়।