খবরইন্ডিয়াঅনলাইন, নয়াদিল্লিঃ সুধীবৃন্দ,
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
চলতি বছর আমরা রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৭৫তম বর্ষ পূর্তি উদযাপন করছি। মানবজাতির প্রগতিতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন অবদানকে স্বীকৃতি জানানোর এটি একটি সুযোগ। আজকের বিশ্বে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভূমিকা ও গুরুত্ব এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এর অবদান মূল্যায়নেরও এটি একটি বড় সুযোগ।
সুধীবৃন্দ,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই যে ৫০টি দেশ রাষ্ট্রসঙ্ঘ গঠন করেছিল, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। তখন থেকে এপর্যন্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ১৯৩টি দেশ রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য। এর সদস্য সংখ্যার সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে আজ বহুস্তরীয় সঙ্কটেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সুধীবৃন্দ,
শুরু থেকেই ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘের উন্নয়নমূলক কাজ এবং ইসিওএসওসি-কে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। ইসিওএসওসি-র প্রথম সভাপতি ছিলেন একজন ভারতীয়। ইসিওএসওসি-র কর্মসূচী তৈরিতে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল౼ সেই সময় স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছনোর রূপরেখাও তৈরি করা হয়। আজ আমাদের অভ্যন্তরীণ উদ্যোগে ২০৩০-এর কর্মসূচী ও স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে আমরা লক্ষ্যণীয় ভূমিকা পালন করছি। অন্য রাষ্ট্রগুলিকে স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য আমরা সাহায্য করছি।
সুধীবৃন্দ,
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশ মানুষ ভারতে বসবাস করেন। আমাদের গুরুত্ব এবং দায়িত্বের বিষয়ে আমরা সচেতন। আমরা জানি, ভারত যদি উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে তাহলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যে পৌঁছনোর জন্য তা সহায়ক হবে। তাই আমরা౼ আমাদের রাজ্যগুলি, আমাদের স্থানীয় প্রশাসন সংস্থাগুলি, আমাদের সুশীল সমাজ, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সার্বিকভাবে এগিয়ে চলেছি।
আমাদের ভাবনা হল – ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ – যার অর্থ, ‘একসঙ্গে প্রত্যেকের বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে প্রত্যেকের জন্য উন্নয়ন।’ এর মাধ্যমে এসডিজি-র মূল নীতিটি অনুরণিত হচ্ছে যেখানে কেউ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হবেন না। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, অথবা আবাসন – সকলে যেন এগুলির সুযোগ পান সেই উদ্দেশে আমরা সমন্বিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি।
সুধীবৃন্দ,
আমাদের ৬ লক্ষ গ্রামে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু করার মধ্য দিয়ে গত বছর আমরা আমাদের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছি।
গত পাঁচ বছরে আমরা ১১ কোটি বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা করেছি। এর ফলে, গ্রামাঞ্চলে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে তা ১০০ শতাংশে পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে౼আগে যার পরিমাণ ছিল ৩৮ শতাংশ। আমাদের বৃহৎ সচেতনতামূলক কর্মসূচির মূল চালিকাশক্তি হলেন আমাদের মহিলারা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা লিঙ্গ সমতা আনতে পেরেছি। বর্তমানে আমাদের জীবিকা মিশনের আওতায় ৭ কোটি মহিলা গ্রামাঞ্চলে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করেছেন। তাঁরা জীবন ও জীবিকাকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছেন। আমাদের স্থানীয় প্রশাসনগুলিতে ১০ লক্ষের বেশি মহিলা প্রতিনিধি নির্বাচিতও হয়েছেন – এর মধ্য দিয়ে অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সূচনা করা সম্ভব হয়েছে। গত ছ’বছরে নতুন ৪০ কোটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে যার মধ্যে ২২ কোটি অ্যাকাউন্ট মহিলাদের। প্রযুক্তির ক্ষমতার সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থাকে যুক্ত করা হয়েছে। এই কাজে প্রত্যেকের জন্য একটি অনন্য পরিচয় সংখ্যা, একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও একটি মোবাইল টেলিফোনের সংযোগ করা হয়েছে যার ফলে, আমরা ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল অর্থ ৭০ কোটি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি পৌঁছে দিতে পেরেছি। আমরা ৮১ কোটি ৩০ লক্ষ নাগরিককে খাদ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাভুক্ত করতে পেরেছি।
আমাদের ‘প্রত্যেকের জন্য আবাসন’ কর্মসূচির মাধ্যমে ২০২২ সালের মধ্যে প্রত্যেক ভারতীয় যাতে একটি নিরাপদ আশ্রয় পান, সেই ব্যবস্থা করতে চলেছি। আগামী বছর ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ পূর্তি। সেই সময়ের মধ্যে ৪ কোটি নতুন বাড়ি এই প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা হবে – যার সংখ্যা বিশ্বে অনেক দেশের বাড়ির সংখ্যার থেকে বেশি। আজ আমাদের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি – ৫০ কোটি মানুষ এই প্রকল্পের আওতায় এসেছেন। আমাদের দেশে কোভিড মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের তৃণমূলস্তরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের সবথেকে ভালো সুস্থ হয়ে ওঠার হারকে নিশ্চিত করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করার জন্য আমরা কাজ করছি। ভারতের উন্নয়নমুখী প্রকল্পগুলির সাফল্য এবং ব্যাপ্তি দেখে অন্যান্য বিকাশশীল রাষ্ট্রগুলি ধারণা লাভ করতে পারে। প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তিকেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। এই ভাবনা থেকে ভারতের নিজস্ব উন্নয়নমুখী অংশীদারিত্ব সারা বিশ্বের দক্ষিণ-দক্ষিণ উন্নয়নের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সুধীবৃন্দ,
আজ যখন উন্নয়নের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি, তখন এই গ্রহের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার কথা আমরা ভুলে যাইনি। বিগত কয়েক বছর ধরে গৃহীত উদ্যোগের ফলে আমরা প্রতি বছর ৩ কোটি ৮০ লক্ষ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে পেরেছি। আমাদের গ্রামগুলিতে বিদ্যুতায়ন, ৮ কোটি দরিদ্র মানুষের জন্য স্বচ্ছ জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এটি সম্ভব হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এর সঙ্গে ওই একই সময়ে ২ কোটি ৬০ লক্ষ হেক্টর জমির মানোন্নয়ন ঘটানো হবে। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান বজায় রেখে বেঁচে থাকাই আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। পরিচ্ছন্নতার জন্য আমরা সর্ববৃহৎ প্রচার কর্মসূচির সূচনা করেছি – একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন করতে উৎসাহ দিচ্ছি। আন্তর্জাতিকস্তরে আমাদের আন্তর্জাতিক সৌর জোট গঠনের মধ্য দিয়ে জলবায়ুর প্রতি বাস্তবমুখী দায়বদ্ধতা প্রকাশ পাচ্ছে। একইভাবে, বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থাপনার জন্য কোয়ালিশন ফর ডিজাসটার রেজিলিয়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার গঠন করে আমরা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণে ব্রতী হয়েছি। আমরা অত্যন্ত গর্বিত যে, আমাদের এলাকায় প্রকৃত বন্ধু হিসেবে আমরা পরিচিত হয়ে উঠেছি। ভূমিকম্প, ঘুর্ণিঝড় অথবা যে কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন সঙ্কটে ভারত দ্রুততার সঙ্গে মোকাবিলা তথা অন্যদের সঙ্গে সহমর্মিতা পোষণ করে থাকে। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ১৫০টি দেশকে চিকিৎসা সহ অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সার্ক কোভিড আপৎকালীন তহবিল গড়ে তুলেছি।
সুধীবৃন্দ,
কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিটি দেশের কাছে সহনশীলতার পরীক্ষা নিচ্ছে। ভারতে আমরা এই মহামারীর মোকাবিলাকে একটি জন-আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি – যেখানে সরকার ও সমাজ যৌথভাবে উদ্যোগী হয়েছে। দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য আমরা সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা ৩ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল অর্থের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছি যার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে, আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে ও প্রযুক্তি-নির্ভর একটি ব্যবস্থা তৈরি করা যাবে। আমরা ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি যেখানে ভারত আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখবে।
সুধীবৃন্দ,
ভারত বিশ্বাস করে স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বহুস্তরীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন। এই বিশ্বের সন্তান হিসেবে আমরা অবশ্যই অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে একে অন্যের হাত ধরব। তবে, বহুস্তরীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিশ্বের বাস্তবতার নিরিখে প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন রয়েছে। আজ মানবজাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্কারকে কেন্দ্র করে বহুস্তরীয়বাদের রূপান্তরের মাধ্যমে আবর্তিত হবে। আজ যখন আমরা রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৭৫ বছর বর্ষ পূর্তি উদযাপন করছি, আসুন সেই সময় আমরা আন্তর্জাতিক বহুস্তরীয় ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য শপথ নিই। এর প্রয়োজনীয়তা বাড়াতে, কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে এবং একটি মানবকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের লক্ষ্যে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মত্ততা থেকে, মহামারীর প্রকোপের মধ্য দিয়ে এর পুনর্জন্ম এবং সংস্কার ঘটাতে হবে। আমাদের এই সুযোগ হারালে চলবে না।
সুধীবৃন্দ,
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে সম্প্রীতি বজায় রাখা, আর্থ-সামাজিক সমতার উন্নয়ন এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এজেন্ডার প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন বজায় রাখবে।
নমস্কার।
ধন্যবাদ। সূত্র – পিআইবি।